রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫২ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫৪ এএম
ফাইল ফটো
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ব্যাংক থেকে সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা তুলে নিয়ে অথবা সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন স্বল্প ও মধ্যবিত্ত আয়ের অনেক মানুষ। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। এমন আর্থিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে বাড়ছে ‘কোটিপতি’ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা। পাশাপাশি এসব হিসাবে গচ্ছিত টাকার পরিমাণও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক ও সামাজিক সূচকগুলোর এমন অবস্থান বৈষম্যমূলক। এ থেকে বোঝা যায়, গরিবরা আরও গরিব হচ্ছেন, ধনীরা হচ্ছেন আরও ধনী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। এসব ব্যাংক হিসাবে মোট জমা টাকার পরিমাণ ৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬২ কোটি। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১ কোটি টাকার বেশি আমানতের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টি। ওই প্রান্তিকে এসব হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ২৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরের তিন মাসে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৩২২টি। একই সময়ে ওইসব হিসাবের বিপরীতে জমার পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। আরও দেখা গেছে, দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪৮ দশমিক ২৮ শতাংশই জমা করেছেন কোটি টাকার হিসাবধারীরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার ২১ দশমিক ১১ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনে একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ মানুষ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। জরিপ অনুযায়ী, শহরের দারিদ্র্য কমলেও আর্থিক দুর্বলতা বেড়েছে। মধ্যবিত্তের আয় কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ, সেই সঙ্গে কমেছে খাদ্যগ্রহণও।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের মানুষের আয় ও পুঁজির এমন বিপরীতমুখী চিত্র থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষমই প্রকাশ পায়। সংকটময় আর্থিক পরিস্থিতির কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা খারাপ সময় পার করছেন। অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় রয়েছেন। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তÑ সব শ্রেণির মানুষই মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত। কিন্তু আরেকটি শ্রেণি নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। যত সংকট থাকুক, কোনো কিছুই তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। শুধু দেশে নয়, পাচার করা অর্থে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার নজিরও বাড়ছে। ওইসব অর্থের কোনো দালিলিক হিসাবপত্র না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দেশে বৈষম্য অ্যালার্মিং লেভেলে পৌঁছে গেছে। মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আবদ্ধ হয়ে আছে উচ্চ আয়ের মানুষের হাতে। যেখানে নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র ১৮ শতাংশ। দারিদ্র্যের চেয়ে এখন বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্য।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৬০৯টি। এসব হিসাবের বিপরীতে জমা হওয়া আমানতের পরিমাণ ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই ‘কোটি টাকা’র হিসাবে জমা।
তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, কোটি টাকার হিসাব মানেই কিন্তু কোটিপতি নাগরিকদের হিসাব নয়। কেননা অনেক ব্যক্তিই যেমন ব্যাংকে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখেন, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠানও রাখে। অর্থাৎ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বলতে যুগপৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের কথাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তারও কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ থেকে ৫ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৫১৬টি। যেখানে জমা ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। ৫ থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত ১২ হাজার ৬৫২টি হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৯ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ৪ হাজার ৮২টি, ১৫ থেকে ২০ কোটির মধ্যে ২ হাজার ২টি, ২০ থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৩৪৫টি, ২৫ থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৯১২টি আমানতকারীর হিসাব। আর ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫১২টি এবং ৩৫ থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৪৮০টি, ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৭৩৮টি। তাছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা ১ হাজার ৮১২টি।
পরিসংখ্যানগতভাবে দেশে প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। ফলে কত মানুষের কোটি টাকা রয়েছে, তার সঠিক হিসাব মেলে না। তবে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা করোনা মহামারির পর থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ছিল মাত্র ৪৭টি, যা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬টি। করোনা মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫, যা এখন ১ লাখ ১৭ হাজারে উন্নীত হয়েছে।