× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রমবাজার

স্বপ্ন দেখানো পোশাক শিল্পে কমছে নারী শ্রমিক

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫৯ এএম

আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪ ১০:০৫ এএম

স্বপ্ন দেখানো পোশাক শিল্পে কমছে নারী শ্রমিক

গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন জেসমিন আক্তার। স্বামীর অল্প আয়ে সংসার চলে না। তাই দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে গার্মেন্টসে চাকরি নেন তিনি। সকালে রান্না করে ছেলেদের সব গুছিয়ে দিয়ে তারপর কাজে যান। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা কাজ করে জেসমিনের আয় মাত্র সাড়ে ১০ হাজার টাকা। জেসমিন বলেন, সংসারে খরচ দিয়ে নিজের জন্য কিছু করার টাকা থাকে না। তা ছাড়া কাজের জায়গায় শুনতে হয় কটুকথা। পুরুষদের তুলনায় নারীদের চ্যালেঞ্জ বেশি বলে জানান তিনি। 

নিজের এক সহকর্মীর কথা তুলে ধরে জেসমিন বলেন, ‘গত মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয় আমাদের এখানে নতুন আসা একটি মেয়ে। ইনচার্জ উত্ত্যক্ত করতে শুরু করলে আমরা অভিযোগ করি। মালিকপক্ষ শাস্তি না দিয়ে উলটো মেয়েটাকে অন্য একজনের অধীনে দিয়ে দেয়। সেখানেও ইনচার্জ নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। যেমন, তাকে বলে দেওয়া হয়, তুমি ওয়াশরুমে গেলেও অনুমতি নিবা। এ বিষয়ে কথা বললে মালিকপক্ষ জানায়, আমরা দেখছি। মেয়েটার চাকরি করার পরিবেশই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।’ নানাভাবে বঞ্চিত এই নারীরা এখনও এই পেশায় টিকে আছেন রীতিমতো যুদ্ধ করে। এমন নানা কারণে পোশাকশিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ কমছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

নানাভাবে শোষিত-বঞ্চিত বাংলাদেশের নারীদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল যে শিল্প, সেখানে এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ শুক্রবার সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশে এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘নারীর সম-অধিকার, সম-সুযোগ; এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। 

যৌন নিপীড়নের প্রতিকার নেই

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত এক নারী তার ভয়াবহ হয়রানির কথা জানান। নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চান না তিনি। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেন। কাবিননামার টাকা থেকেও বঞ্চিত হন তিনি। তাই বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে নামেন; যোগ দেন একটি পোশাক কারখানায়। নিজের আয়েই সন্তান ও নিজের খরচ বহন করেন তিনি। পাঁচ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছেন তিনি। তিনি বলেন, এই কারখানায় কোনো যৌন হয়রানি কমিটি কখনও ছিল না। আমার ঘটনার পরে কমিটি করা হলেও সেখানে আছে উত্ত্যক্তকারীর শ্বশুর।

তিনি বলেন, ‘একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তায় আমাকে কয়েকজন ছেলে আটক করে অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দেয়। এমনকি আমার স্বামী নেই সেই কথা উল্লেখ করে কটুকথা বলে। নিরাপত্তাহীনতায় অফিসে অভিযোগ জানালে সেখান থেকে বলা হয়, এটা অফিসের বাইরের ঘটনা। তারা কিছু করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘বাধ্য হয়ে মায়ের বাসা ছেড়ে অফিসের কাছে বাসা নিই। সেখানে আমার চার হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। মেয়েটাকে এখন মায়ের কাছে রেখে আমি এই বাসায় একা থাকি। সব প্রমাণ থাকার পরও সেই ছেলেটার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। এখনও সে আমাকে দেখলে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। যেহেতু রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়, এই জটিলতা আরও বেশি।’

অবনী ফ্যাশনে চাকরি করেন আসমা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কমিটিকে কখনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। সব সময় তারা বলে তোমরা যাও, দেখছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনরাই ভোগায়। তাই চাকরি যাওয়ার ভয়ে অনেকেই কথা বলে না।’

মাতৃত্বকালীন ছুটির আগে নানা অজুহাতে ছাঁটাই

শাহানা বেগমের দুই সন্তান। ছোট সন্তানের এখন দুই মাস। স্বামী অন্যত্র সংসার শুরু করেন যখন তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এ নিয়ে শালিস হলে তাকে কাবিনের টাকা ও সন্তান ডেলিভারির খরচসহ দুই সন্তানের ভরণ-পোষণের খরচ দেবেন স্বামী। তবে কিছুই পাননি এই নারী। বরং ডেলিভারির আগে কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। ধার করে হাসপাতালের টাকার জোগান দেন। ছোট সন্তান এখন বুকের দুধ পায় না ঠিকমতো।

তিনি কান্না করতে করতে বলেন, ‘আমি ঢাকা ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছি। যখন নয় মাস তখনও আমি ফ্যাক্টরিতে যাই কাজ করতে। একটা সময় শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। ছুটিও চাইতে যাইনি। কিছু সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাকে বলা হলো, তোমার আইডি কার্ড জমা দিয়ে চলে যাও। আমি অভিযোগ জানাই। আমার ছুটির টাকা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি বুঝিয়ে দিতে বলি। কিন্তু কোনো পাওনা টাকাই আমাকে তারা দেয়নি। চাকরিচ্যুত হয়ে আমি এই সংসার টানতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে করেই মেয়েরা গর্ভবতী হলে তাদের নানা অজুহাতে ছাঁটাই করা হয়।’

তামান্না মৌচাক কোনাবাড়ীতে লিলিক নামে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। তার সেক্টর ছিল ফিনিশিং। যেখানে কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। সকাল ৮টায় কাজে গেলেও কখনও কখনও রাত ১২টায় ফিরতে হতো। এর বিনিময়ে মাত্র ১৪ হাজার ২৩১ টাকা বেতন পেতেন তিনি। নিজের পুরোটা সময় দিয়ে এই টাকায় কোনো রকম সংসার চলত তামান্নার। তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তার পাওনা দেওয়া হয়নি।

আরও যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

তৈরি পোশাকশিল্প, যেখানে শুরুর দিকে বাংলাদেশে ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী শ্রমিক, সেই শিল্পে তাদের হার সম্প্রতি কমতে শুরু করেছে। এর পেছনে নানা রকম কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ২০১৭ সাল থেকে ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি) প্রকল্পের অধীনে ডিজিটাল মানচিত্রের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার অবস্থান, শ্রমিকের সংখ্যা ইত্যাদি তথ্য নথিভুক্ত করছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল মানচিত্রে তিন হাজার ৭২৩টি কারখানা যুক্ত হয়েছে। এসব কারখানার ৫৮ শতাংশ নারী। আর ৪২ শতাংশ পুরুষ। অথচ গত শতকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে এ শিল্পের শুরুর দিকে প্রায় শতভাগ ছিল নারী শ্রমিক।

একতা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার ফেডারেশনের কো-অর্ডিনেটর লোকমান আলী বলেন, ‘জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। হঠাৎ পরিবারের কেউ মারা গেলে শ্রমিকরা ছুটি পান না বেশি সময়ের জন্য। শ্রমের ঘামের তুলনায় তাদের যে টাকা দেওয়া হয় তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে নিজের প্রাপ্য কিছুই তারা পান না। এ ছাড়া মেয়েদের ওপর যৌন নিপীড়ন হয় বেশি। এসব কারণে নারীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে পোশাকশিল্পে।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য ড. রুবানা হক বলেন, সম্প্রতি যে ধরনের মেশিন আসছে পোশাক খাতে, সেখানে শিক্ষিত ছেলেরা সুযোগ পাচ্ছে। সেটা একটা কারণ নারীদের কমে যাওয়ার পেছনে। নারীদের প্রতি বৈষম্য ও যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১২০০ ফ্যাক্টরি আইনের মধ্যে থাকলেও বেশিরভাগই এর বাইরে। সেগুলো দেখার কোনো অভিভাবক নেই। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএ একটি সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, পোশাক খাতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র চালাতে সক্ষম কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। আধুনিক এসব যন্ত্র ব্যবহারে নারীদের সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেকে পিছিয়ে পড়ছেন। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে পোশাকশিল্পের ভূমিকা রয়েছে। ধরে রাখতে হলে নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে।

নারী অধিকারকর্মী ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, পোশাক খাতে ৮০ শতাংশ নারী ছিল তা এখন ৬০ শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ অটোমেশন পদ্ধতি। যে ধরনের যন্ত্রপাতি আসছে তা নারীরা ব্যবহার করতে পারছে না। দ্বিতীয় হলো অতিরিক্ত চাপ ও কারখানায় ডে কেয়ার না থাকা। একজন নারীকে বাসায় ও বাইরে দুটো জায়গায় শ্রম দিতে হয়। যাদের বাচ্চা আছে তারা ডে কেয়ার না থাকায় ছোট বাচ্চা নিয়ে কাজ করতে পারে না। তৃতীয়ত, সুপারভাইজার বা ইনচার্জের মতো বড় পদে নারীদের দেখা যায় না। তার মধ্যে মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে চলা অসম্ভব।

মাতৃত্বকালীন ছুটি ও যৌন হয়রানির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১২০ দিন সবেতনে ছুটি দেওয়ার কথা থাকলেও মালিকরা সেটাকে চাপ মনে করে। নারীদের সেই অবস্থায় ভারী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। যখন বিশেষ সুযোগ পাওয়ার কথা নারীদের, সেই মাতৃত্বের কারণেই চাকরিহারা হন তারা। আজ থেকে ১৫ বছর আগে এত বেশি যৌন হয়রানির বিষয়গুলা নিয়ে কথা হতো না।

সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তিনি বলেন, এর প্রতিরোধে ভুক্তভোগী নারীদের নিজেদের কথাগুলো বলতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের চাকরি হারানোর ভয় থাকে। নারীর কর্মপরিবেশ তৈরিতে যৌন হয়রানিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নারী আন্দোলন মধ্যবিত্তদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে শ্রমজীবীদেরও আসতে হবে। নারী অধিকার কর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা