প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪ ১২:২৭ পিএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৪ পিএম
ফুলবাড়ী পৌর এলাকার পূর্ব গৌরীপাড়া কৃষি জমিতে কাজ করছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কয়েকজন শ্রমিক
ফুলবাড়ী পৌর এলাকার পূর্ব গৌরীপাড়ার তমাল হোসেনের জমিতে বোরো চারা রোপণ করছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১১ জনের একদল নারী কৃষিশ্রমিক। সবাই ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাশের বিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের বুচকি আদিবাসীপাড়ার বাসিন্দা তারা। কৃষক তমালের ৬ বিঘা জমিতে বোরো চারা রোপণের চুক্তি নিয়েছেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কাজ করবেন। চুক্তি অনুযায়ী দুপুরে নাশতা বাবদ জনপ্রতি ২০০ গ্রাম মুড়ি পাবেন আর কাজ শেষে মজুরি ৩৫০ টাকা করে।
তারা হলেন শ্যামলী মুর্মু (২৮), রুফিনা হাঁসদা (৩০), নির্মলা মার্ডি (৩৮), আরতি সরেন (৪৪), জুলিয়ানা মার্ডি (৪২), বাসন্তী সরেন (৩৫), লিলিনা মুর্মু (৩৬), গোলাপী বেসরা (৩৮), গোরতি কিস্কু (৩৪), চিনিমন সরেন (৩৬) ও লিলিয়ানা হেমব্রম। গৃহস্থালির পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করেন। উপার্জন দিয়ে তাদের সংসার চলে।
এত কিছুর পরও সমাজে সে অনুযায়ী মর্যাদা, পারিশ্রমিক পান না নারী কৃষিশ্রমিকরা। শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক মর্যাদা, পারিশ্রমিক সবকিছুতেই পিছিয়ে। পরিশ্রম, কাজের মান ও দক্ষতা সমান থাকা সত্ত্বেও কোন দিক থেকে তারা পিছিয়ে রয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার উত্তর একই- কাজের মান ও কর্মদক্ষতায় নয়, নারী পিছিয়ে শুধু মানসিকতায়। আর সে কারণেই বেতন বৈষম্য নারী-পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে।
সংসারের যাবতীয় কাজ সামলানো, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, রান্নাসহ বাড়ির সব কাজ সেরে বাইরে কাজে যেতে হয় তাদের। প্রায় সমান সময় ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করার পরেও বেতন বৈষম্যে চরম ক্ষোভ তাদের মাঝে। এর জন্য দায়ী করেন মহাজনদের মানসিকতাকে।
ধান-গম কাটা ও লাগানো, জমি নিড়ানো, ধান মাড়াইয়ের কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। ধান কাটা ও লাগানোর মৌসুমে পুরুষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৫০০-৫৫০ টাকা হলেও নারী পাচ্ছেন ৩৫০-৪০০ টাকা। অথচ একসঙ্গে একই সময়ে একই কাজ করেন নারী-পুরুষ শ্রমিকরা।
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নারী কৃষিশ্রমিক জুলিয়ানা মার্ডি বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘর পরিষ্কার করার পর রান্না করেন। তখনও স্বামীরা ঘুমিয়েই থাকেন। এর মধ্যে রান্না শেষে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে নিজে খেয়ে সকাল ৮টার মধ্যেই জমিতে কাজ করতে বেরিয়ে পড়েন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বেজে যায়। বাড়িতে এসেই রাতের রান্নার কাজে হাত দিতে হয়।
এই গোষ্ঠীর আরেক নারী কৃষিশ্রমিক বাসন্তী সরেন বলেন, বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে কম পারিশ্রমিকেই কাজ করতে হয়। অথচ এত কাজ বা পরিশ্রম করেও নিজেদের ন্যায্য অধিকার পান না। পুরুষ যতটুকু কাজ করেন তারাও ঠিক ততটুকুই করেন। কিন্তু মজুরি পান অনেক কম। এ ব্যাপারে তাদের দিকে কেউ নজর দেয় না।
গোলাপী বেসরা (৩৮) বলেন, ‘কৃষিকাজ করতে করতে আমাদের জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। অভাবের সংসার তাই বাধ্য হয়েই স্বামীদের সঙ্গে কৃষিজমিতে কাজ করতে হয়। ঠিকমতো কাজও পাই না। স্বামী ও আমাদের মিলে উপার্জন করা টাকায় সংসার চলে। এত কঠোর পরিশ্রমের পরও কোনো উন্নতি হয় না আমাদের। খাটতে খাটতে এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে।’
জমির মালিক পূর্ব কাঁটাবাড়ী গ্রামের কৃষক হীরেন্দ্রনাথ বর্মণ ও আলাদিপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুরুষ শ্রমিকের মতোই নারী শ্রমিকরাও একই সময়ে কাজ শুরু করেন। একই সময়ে শেষ করেন। তাদের দেখে কষ্ট লাগে। আদিবাসী নারীরা খুবই পরিশ্রমী। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। কারণ তারা খুবই অসহায়। এভাবেই তাদের বেতন বৈষম্য চলে আসছে। তাই আমরাও কম পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছি।’
নারীদের সমঅধিকার আজও বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে উপজেলা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ও ফুলবাড়ী শহীদস্মৃতি আদর্শ কলেজের প্রভাষক চন্দনা রানী বলেন, ‘বৈষম্য দূর করতে পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে নারী শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন হবে না। নারীর ওপর অন্যায় করা হচ্ছে। মজুরি বৈষ্যম দূর করার জন্য সব স্তর থেকে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, ‘কৃষিকাজের সর্বত্র নারীর অবাধ বিচরণ। চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, ধান কাটা-মাড়াই, পাটের আঁশ ছাড়ানো, পাটকাঠি শুকানোর কাজ নারী করেন। কাজের তুলনায় নারীকে মজুরি কম দেওয়া হয় বলে শোনা যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ানো দরকার। না হলে নারী কৃষিতে আগ্রহ হারাবেন।’