রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৪৩ এএম
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৮ পিএম
বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) অ্যানা বেয়ার্দের ঢাকা সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে সবচেয়ে বড় অংশীদার হিসেবে সংস্কারের শর্ত জুড়ে দিয়ে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা। প্রতিশ্রুত ৫০টি প্রকল্পের আওতায় ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পেতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এ সংস্কার শর্ত। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর দৃশ্যমান উন্নয়নও দেখতে চায় বিশ্বব্যাংক। তাই দেশের অগ্রসরমান অর্থনীতি টেকসই করতে নিজেদের প্রয়োজনেই কাঠামোগত সংস্কারের বিকল্প দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।
গত রবিবার বাংলাদেশে প্রথম সফর শেষে এক বিবৃতিতে অ্যানা বেয়ার্দ বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গল্প অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। মুদ্রা ও রাজস্ব নীতিতে দ্রুত এবং সাহসী সংস্কার বাংলাদেশকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, আর্থিক খাতের ঝুঁকি হ্রাস করতে এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম করবে।
বেয়ার্দের সফর দেশের কী কী সুখবর বয়ে আনতে পারে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটি একটি উচ্চপর্যায়ের সফর ছিল। বাংলাদেশের জন্য এটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক আমাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে সেগুলো পেতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই করতে হবে। বোঝা যাচ্ছে তারা সামাজিক সুরক্ষা খাতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এর প্রথম অগ্রাধিকার।’
বর্তমানে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী বেশকিছু কাঠামোগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবু আর কী সংস্কার চাইছে বিশ্বব্যাংক; এমন প্রশ্নে ড. জাহিদ বলেন, ‘আইএমএফের সংস্কার প্রস্তাব সার্বিক অর্থনীতির সব খাতকে কাভার করছে না বলেই আরও সংস্কার চাইছে বিশ্বব্যাংক। বাস্তবতা হলো আমাদের এগিয়ে যেতে হলে নিজেদের প্রয়োজনেই কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে।’
বেয়ার্দ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সহায়তা করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে তুলতে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং জলবায়ুর অভিঘাত ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে কেউ যেন পেছনে পড়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও মিলেছে।’
এর আগে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বেয়ার্দ জানান, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ৫০টি প্রকল্পের আওতায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পেতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
বেয়ার্দ বলেন, ‘আইডিএর বেশকিছু প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের পার্টনারশিপ বিষয়ে আমি গুরুত্বারোপ করতে চাই। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ আমাদের বৃহৎ গ্রাহক। আমরা আমাদের চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বিষয়ে কথা বলেছি। প্রায় ৫০টি প্রকল্পের আওতায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের এখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যথাযথভাবে জানতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বেশকিছু সংস্কারের বিষয়ে কথা বলেছি। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে কিছু সংস্কার। এ ছাড়া অর্থনৈতিক প্যারামিটারগুলো সমন্বয় করতে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যথায় জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের প্রোগ্রামগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ উপকৃত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন বেয়ার্দ। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। পাশাপাশি তাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী উভয়ের প্রয়োজন মেটাতে দুটি প্রকল্পে ৬৫ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছে বিশ্বব্যাংক ও সরকার।
অর্থায়নের প্রায় অর্ধেক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যয় করা হবে এবং অনুদানের শর্তেই তা ব্যয় করা হবে। বাংলাদেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে দৃঢ় সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস)।
সংস্কার প্রশ্নে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের বেশকিছু সংস্কার প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় প্রকৃত সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিরা সুরক্ষা ভাতা পায় না। ক্ষেত্র বিশেষে পুরো অর্থ তছরুপ হয়।’
অন্য সংস্কারের মধ্যে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ জরুরি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কেবল পোশাকের ওপর ভর করে রপ্তানি বাজার ধরে রাখা যাবে না; অর্থাৎ কমোডিটি ডাইভার্সিফিকেশন দরকার। এ ছাড়া নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। যেগুলো হয়েছে সেখানে রপ্তানি বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হওয়া চলবে না।’
তা ছাড়া রেমিট্যান্স আহরণে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। কারণ অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে খুব বেশি লাভবান হওয়া যায় না। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। আমাদের কর জিডিপির অনুপাতও খুবই খারাপ অবস্থানে আছে, এটি বাড়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আইডিএর অর্থায়নে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ ও রেয়াতি ঋণ আকারে প্রায় ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বের বৃহত্তম চলমান আইডিএ কর্মসূচি এবং বিশ্বব্যাংক।