ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৪ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৫ এএম
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সেই সরকারের নতুন মন্ত্রিসভার মেয়াদও এক মাস পূর্ণ হয়ে গেল। গত ১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। প্রথমদিন থেকেই এই সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গায় রয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। গত এক মাসে এ ইস্যুতে কাজের কাজ কতটুকু হয়েছেÑ সঙ্গত কারণেই সেটি আলোচনায় উঠে আসছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব বাজারে দেখা গেছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অব্নতিও ঘটেছে। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নেওয়া বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে রমজান মাসের প্রয়োজনীয় ৮ ধরনের খাদ্যপণ্য যেমন- ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর বাকিতে আমদানির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চাল, চিনি, ভোজ্য তেল ও খেজুর আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালের দাম নাগালে রাখতে নিয়মিতই জেলাপর্যায়ে গিয়ে চালকল মালিক, করপোরেট কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। মন্ত্রণালয় থেকে অভিযানও চালানো হচ্ছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে চলেছেন। সব মিলিয়ে উদ্যোগ-তৎপরতায় ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এতকিছুর পরও নিত্যপণ্যে দাম বৃদ্ধি থেমে নেই। গত এক মাসে চালের দাম তো বেড়েছেই, আরও অনেক পণ্যের দামই আর আগের জায়গায় নেই। গত এক সপ্তাহেই সারা দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
সরকারের এত চেষ্টা আর উদ্যোগের পরও কেন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে নাÑ এ বিষয়টি নিয়ে দেশের কৃষি অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশ্লেষক ও ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত ৯টি বিষয়ে নজর দেওয়ার গুরুত্ব দিয়েছেন।
রমজান মাসে ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে এরই মধ্যে চাল, চিনি, ভোজ্য তেল ও খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, প্রয়োজনে জরুরি আইন প্রয়োগ করে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
অন্যদিকে ভারত সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গত শুক্রবার দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের সঙ্গে বৈঠক করে রমজান মাসে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। বিশেষ করে রমজানের আগেই ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ এবং ১ লাখ টন চিনি রপ্তানির অনুরোধ জানান তিনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন সরকারের সদিচ্ছার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সমস্যার মূলে যেতে হবে। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এভাবে চিন্তা করা গেলে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। যদি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মজুদদার বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কেননা তারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকেই অপরাধ করে। ক্ষমতাসীন দলের পোশাক পরে অপরাধ করছে। সিন্ডিকেট হোক, মজুদদার বা অতিমুনাফাখোর হোকÑ তাদের অধিকাংশই সরকারদলীয় লোক। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে প্রশাসন কিছু করতে পারবে না।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মন্ডল বলেন, এবার প্রচুর শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ চেইন ঠিক ছিল না। এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে মার্কেট চ্যানেলকে সহজীকরণ করার দরকার ছিল। শুধু বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদনের জায়গায় দাম কম থাকে। যেখানে কৃষকের লাভ থাকে ২ টাকা, সেখানে দেখা যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করে ১০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে এক এলাকায় উৎপাদিত সবজি অন্য এলাকায় সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিতে পারত। এসব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং সিস্টেম তেমন উন্নত নয়। অথচ দেশের উপজেলা পর্যায়েও বেশকিছু লোকবল নিয়োগ দেওয়া আছে। সেখানে যদি কোনো ফসল কী পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে, তা কোথায় সরবরাহ করতে হবে এসব সঠিকভাবে মনিটর করা হতো, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
দ্রব্যমূল্য না কমার ক্ষেত্রে চারটি কারণ তুলে ধরেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার। তিনি বলেন, প্রথমত দ্রব্যমূল্য জোর করে কমানোর কিছু নেই। বর্তমানে বাজারে যেভাবে মূল্যতালিকা দেওয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়। যেসব তথ্যের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পিত চাহিদা নিরূপণ করা হয়, দেশে তা করা হচ্ছে না। আমাদের জনসংখ্যা কত, তাদের আয়-ব্যয় কত, খাদ্যাভ্যাস কীÑ এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই, গবেষণা নেই। জনসংখ্যা বেশি হলে পণ্যের ঘাটতি তো হবেই। জনসংখ্যার ভিত্তিতেই পণ্য আমদানি করতে হবে। দেশে কী পরিমাণ উৎপাদন করা দরকার, বাজারে কী পরিমাণ পণ্য ছাড়া দরকারÑ এসব বিষয় নির্ভর করে থাকে এর সংখ্যার ওপর। জনসংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকা পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ। কেননা আমরা এক ধরনের জনসংখ্যার হিসাব ধরছি আর প্রকৃত সংখ্যা আরেকটা।
দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতির কারণ মানি সাপ্লাইয়ের আধিক্য। বাজারে বেশি পরিমাণ অর্থ থাকলে সেটি দ্রব্যের দাম বাড়াবেই। একটা সময় পর্যন্ত ইন্টারেস্ট রেট কম থাকায় মার্কেট থেকে তারল্য তুলে নেওয়া যায়নি। এখন ইন্টারেস্ট রেট ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় অনেকেই সঞ্চয়ে যাবে। অনেকেই টাকার ভ্যালু নেই বলে খরচ করে ফেলত, তারা এখন তা সঞ্চয় করবে। ব্যাংকে টাকা ফিরে আসবে। তবে এই কারেকশন রাতারাতি হবে না। এজন্য তিন বা চার মাস অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মনিটরিং ছাড়াও আরও কিছু দিক আছে, যা মার্কেটকে পরিচালিত করে। তার মধ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। দেশের কয়েকটি কোম্পানি মিলে মার্কেটটি কব্জা করে রেখেছে। অধিক পরিমাণ সরবরাহকারী না থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে না।
সরকারের মজুদ বাড়ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রাইভেট সেক্টরের জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এখানে সরকারের সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রের মধ্যে একমুঠো খাবার ফেলার মতো। অর্থাৎ সরকার প্রায় পুরোপুরিভাবে প্রাইভেট সেক্টরের জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে তিনটি কারণ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখানে তিনটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, টাকার অবনমন। আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমলেও দেশে টাকার মূল্যমান অবনমনের কারণে তা কমছে না। দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা নেই। বিশেষ করে আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর, স্থানীয় উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তর পর্যন্ত আগের মতো প্রতিযোগিতা নেই। কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এটি ভোজ্য তেল, চিনি, ডাল, যার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে চাল। যারা এসব করছে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য বা প্রতিযোগিতা কমিশনের আরও সক্রিয় ভূমিকা দরকার। তৃতীয়ত, চাহিদা, উৎপাদন ও প্রয়োজন কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এতে কখন কী পরিমাণ পণ্য ছাড়তে হবে তার হিসাব পাওয়া যায় না। আমাদের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও চাহিদা কত, উৎপাদন কত ও কখন কতটুকু বাজারে ছাড়া হবে তার সঠিক তথ্য নেই। কখন কতটুকু আমদানি করতে হবে, সেসবের সমন্বয় নেই। এখানে অনেক দুর্বলতা আছে। তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না টাকার মূল্যমানের অবনমন বন্ধ হয়ে একটি স্থানে স্থির হবে, ততক্ষণ এসব চলতেই থাকবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করতে চাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়লে পণ্যমূল্যের ওপরও পড়বে। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি পণ্যমূল্যকে উস্কে দিচ্ছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অনেক পণ্যের নিয়ন্ত্রণ কিছু প্লেয়ারের হাতে চলে গেছে। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না অথচ ভোক্তাকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।