প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:৩৩ এএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৩০ পিএম
প্রবা ফটো
রাইট অফ তথা অবলোপন পদ্ধতিতে হিসাবের খাতা থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিয়ে ব্যাংকের আর্থিক চিত্র ভালো দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। লুকানো এ ঋণ আদায়ে তেমন কোনো তৎপড়তা নেই। তবুও নতুন করে সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুছে ফেলার লক্ষ্য ঠিক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে এ কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবলোপন ঋণ আদায় হতাশাজনক। চার বছরে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বর্তমানে এ খাতের ৬টি ব্যাংকে অবলোপন ঋণ রয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিতে পারলেই এটি অন্তরালে চলে যায়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর কাজ শেষ হলে এসব ঋণ আর আদায় করার গুরুত্ব অনুভব করেন না কর্মকর্তারা। এমন প্রেক্ষাপটে এটিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি কমানোর যে রোডম্যাপ হয়েছে তাতে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে পড়বে ব্যাংক খাত। তবে এর মাধ্যমে সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে। আদায় ছাড়াই হিসাব কম দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি ছাড়া কোনো লাভ হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অবলোপন হওয়া ঋণ আদায়ে তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। চার বছরে আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৮ হাজার কোটি টাকার বোঝা থেকে বছরে গড়ে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা করে আদায় করছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংক। হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সোনালী ব্যাংক অবলোপন ঋণ আদায় করেছে ৫৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া জনতা ৮৭ কোটি, অগ্রণী ৫৬ কোটি, রূপালী ১৬ কোটি, বিডিবিএল ৩৩ কোটি এবং বেসিক ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ৫ কোটি টাকা।
তবে ২০২০ সালের পর থেকে বেসিক ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকের অবলোপন স্থিতি বাড়েনি। আলোচিত সময়ে নতুন অবলোপন এবং আদায়ে ভারসাম্য ছিল। অল্প হলেও আদায়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মোট স্থিতি কিছুটা কমেছে। তবে সার্বিক অবলোপন স্থিতি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবলোপনকৃত ঋণ ও আদায়ের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালে সোনালী ব্যাংকের অবলোপন স্থিতি ছিল ৬ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬১১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ চার বছরে আদায় স্থিতি কমেছে মাত্র ৩৮৩ কোটি টাকা।
২০২৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। যা ২০২০ সালে ছিল ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে চার বছরে লুকানো হিসাবের মাত্র ২৭০ কোটি টাকা কমাতে পেরেছে ব্যাংকটি। চার বছরে অগ্রণী ব্যাংকের অবলোপন ঋণ ৪৩৯ কোটি টাকা কমেছে। ২০২০ সালে ছিল ৪ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে হয়েছে ৩ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে রূপালী ব্যাংকের অবলোপন স্থিতি ৩২ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৬৭ কোটি টাকায়। ২০২০ সালে এ অঙ্ক ছিল ৫৯৯ কোটি টাকা। বিডিবিএলের অবলোপন ঋণ ছিল ১ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে স্থিতি কমেছে মাত্র ২২০ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে বর্তমানে অবলোপন ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। গত বছর শেষে বেসিক ব্যাংকের অবলোপন ঋণ স্থিতি ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। চার বছর আগে ২০২০ সালে ছিল ৪৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরে বেসিক ব্যাংকের অবলোপন ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপন স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা ২০২২ সালে ছিল ১৮ হাজার ১১৩ কোটি। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের ঋণ অবলোপন বেড়েছে ২৭ কোটি টাকা। চার বছর আগে ২০২০ সালে এ অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে বেড়েছে ৬৪৪ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বচ্ছতা ছাড়াই ঋণ বিতরণের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাশালীদের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা আর আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে এখন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তবে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। আইএমএফের শর্তের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০২২ সাল শেষে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি বা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। সেখানে কোনো ঋণ তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর ‘মন্দ মান’ হিসেবে খেলাপি হলেই তা অবলোপন করে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ উপায়ে সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ কমানো হবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ছিলÑ ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ ৩ বছর ধরে আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজার বুকে সংরক্ষণ করা হয়। এর আগে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন এবং অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ নামে পরিচিত। এভাবেই ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো।