× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বংশপরম্পরায় পিঠার পেশা!

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৫৭ পিএম

আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩১ পিএম

মিরপুর ১১ সেকশনে ক্রেতাদের পিঠা দিচ্ছেন মো. গুড্ডু। প্রবা ফটো

মিরপুর ১১ সেকশনে ক্রেতাদের পিঠা দিচ্ছেন মো. গুড্ডু। প্রবা ফটো

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাশের দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন মো. ইদু মিয়া। থাকার কোনো জায়গা ছিল না। সেখান থেকেই অনেক কষ্টে পিঠা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে শুরু করেন পিঠা বিক্রি। চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা দিয়ে শুরু করলেও তার দোকানে এখন বিক্রি হয় ১০ রকমের পিঠা। সঙ্গে আছে ৫২ রকমের ভর্তাও। বংশপরম্পরায় এ দোকানে এখন কাজ করেন তার নাতি মো. গুড্ডু। দাদির কাছ থেকে দাদার এই পিঠা বিক্রির নানান গল্প শুনেছেন তিনি। গুড্ডুর সঙ্গে কথা হয় মিরপুর-১১ নম্বরের বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঢালে তার দোকানে। গুড্ডু তার দোকানের নাম রেখেছেন ‘গুড্ডু মামার পিঠার দোকান’।

বিকাল হতেই গুড্ডুর পিঠার দোকানে ভিড় জমে। শীত কমতে শুরু করলেও ক্রেতা এখনও ভরপুর বলে জানান তিনি। পিঠা সাজাতে সাজাতে তিনি বলেন, এখানে পিঠা বিক্রি করে আমার পরিবারের সচ্ছলতা এসেছে। শীতে পিঠা বিক্রি করি আর গরমে শরবত। খুব বেশি সঞ্চয় করার মতো কিছু না থাকলেও যতটুকু থাকে তা দিয়েই সংসার চলে। দাদা ভারত থেকে এখানে এসে জীবন ধারনের জন্য পিঠা বানানো শুরু করেন। তারপর আমার বাবা মো. ইলিয়াসও এই পিঠা বানানো শুরু করেন। তখন বেশি পিঠার আয়োজন ছিল না। 

গুড্ডুর সংসারে রয়েছে তিন ছেল-মেয়ে। তার সঙ্গেই কাজ করছিলেন তার বড় ছেলে মো. রিয়াজ। এসএসসি পরীক্ষার পর আর কোথাও ভর্তি হননি। আবারও পড়াশোনা শুরু করবেন বলে জানান তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি দশ বছর বয়স থেকেই বাবার দোকানে কাজ করছেন। রিয়াজ বলেন, প্রতিদিন এখন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হয়। ১৬টি চুলায় পিঠা বানাতে এখানে আছেন ১০ জন কর্মচারী। পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা, পাটি সাপটাসহ আছে ১০ রকম পিঠা। দুই রকমের চিতই পিঠা হয় এখানে। একটা ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়, আরেকটা ঘি দিয়ে। এই দুই রকম পিঠা খেতেই বেশি ভিড় হয়। ভাপা পিঠা ২০ টাকা থেকে শুরু হয়। বাকি সব ১০ টাকা করে। এ ছাড়া ১৩০ টাকার প্যাকেজে বিভিন্ন রকম পিঠা সাজিয়ে দেন তিনি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানে আসেন গুড্ডুর মা বানু খাতুন। কথার প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন এ জায়গা ছিল জঙ্গল। প্রচুর গাছগাছালি ছিল। বসতি হয়েছে আরও পরে। আমার শ্বশুর প্রথমে এখানে এসে কাজ শুরু করেন। তিনি ওই দেশেও পিঠা বিক্রি করতেন। কেন ভারত ছেড়ে এখানে এসেছেন তা আমাদের কখনও বলেননি। আমি আর আমার বরও পরে আসি এখানে শ্বশুরের কাছে। সে সময় এক আনায় পিঠা বিক্রি হতো। এখন দাম ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা হইছে।

এই দোকানে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন মো. আইয়ুব। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে এই দোকানের পরিবর্তন হয়েছে। আমি এসে এখানে আরও চারটা পিঠা যোগ করেছি। এখন বেতনভুক্ত কাজ করি। এসব পিঠা বানানো শিখছি বিভিন্ন জায়গা থেকে। প্রথম আট আনা বেতনে এ কাজ শুরু করি। এখন সব বানাইতে পারি।

গুড্ডু মিয়ার মতো পুরাতন এলিফেন্ট রোডে পিঠা বিক্রি করেন কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মেঘমালা। দুটি চুলায় শুরু করেছিলেন, এখন ১২টি চুলায় পিঠা বানান তিনি। ঢাকায় এসেছিলেন সবকিছু হারিয়ে। তিনি বলেন, বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে যায়। যা কিছু ছিল সব হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় স্বামী সবুজ মিয়াকে নিয়ে এক কাপড়ে ঢাকায় আসেন। 

কীভাবে এই পিঠা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হলেন জানতে চাইলে বলেন, আমাদের হাতে কোনো টাকা ছিল না। চার ছেলে-মেয়েকে আত্মীয়র বাসায় রেখে ঢাকায় এসে পড়ি। থাকার কোনো জায়গা ছিল না। প্রথমে হোটেলে কাজ নেই। এত পরিশ্রমের কাজ, ঘুমানোর সময়ও ছিল না। সেদিন থেকেই মনে হলো নিজেরা কিছু একটা করব। দুই মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল টাকার অভাবে। পরে মানুষের বাসায় কাজ করতে শুরু করলাম।

কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে বলেন, মালিককে বললাম আমি পিঠা বানাতে পারি, একটা ব্যবস্থা করে দেন, শুরু করলে ভালো করতে পারব। তারপর মালিকের সহযোগিতায় শুরু করলাম। তখন মাত্র দুইটা চুলা ছিল। সবাই খুব মজা করে খায়, তারপর এখন ১২টা চুলা দিয়ে কাজ করি, তাও হয় না। বড় দুই মেয়েকে সেদিন পড়াতে না পারলেও ছোট দুইটাকে আবারও স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। সেদিন এই শহরে ভাইসা আসছিলাম, ভাবি নাই কিছু পারমু। অনেক কষ্ট করছি, ফলও পাইছি।

৩৫ বছর ধরে শাহবাগে পিঠা বিক্রি করেন মো. জীবন ও সাথী দম্পতি। বিয়ের আগে থেকেই জীবন পিঠা বিক্রি শুরু করেন। তার সঙ্গে পরে এ কাজেই সহযোগিতা করতে শুরু করেন সাথী। সাথী বলেন, পিঠার দাম ছিল তখন ১ টাকা, চার বছরের মাথায় দাম হলো ২ টাকা। তারপর খুব তাড়াতাড়ি দাম বাড়তে শুরু করল। ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা হলো। এখন ১০ টাকাতেই আছে। গত বছর থেকে আমি বিক্রি করি ১৫ টাকা দিয়ে। তবে ১০ টাকার পিঠাই দীর্ঘসময় ধরে টিকে ছিল। এখনও টিকে আছে। 

দাম বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গুড়ের দাম তো বাড়েছে। আমরা তো পিঠার দাম বাড়াইনি। আমাদের লাভ কেমন করে হবে। রাজশাহী থেকে ভালো গুড় নিয়ে আসি। পিঠাটা যত্ন করে বানাই। কাউরে খারাপ কিছু খাওয়াতে চাই না। 

তবে আছে নানান জটিলতাও। তিনি বলেন, অনেকেই পিঠা নেয়, টাকা দেয় না। প্রতিদিন প্রায় ১০০ টাকার পিঠা এমনেই চলে যায়। গরমে শরবত বানাই, সেটা কেউ এমন করে নেয় না। পিঠাটা মানুষ খুব মজা করে খায়। তবে শরবতেই লাভটা বেশি হয়।

পাঁচ ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ সাথীর সংসার। তিনি বলেন, ‘মেজো ছেলে কাজ পায় না, তাই টিএসসির গেটে ওরেও সব আয়োজন (পিঠা বিক্রির) করে দিছি। নিজেরটা করে খাক। কত বেটা মানুষ পিঠা বিক্রি করে। এখানে আইসা নারী-পুরুষের ভাগ নাই। সবাই এ কাজ করে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা