× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইইএফ ঋণ লুটপাট

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০১:০৮ এএম

আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৩৮ এএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বিনা সুদে মূলধন সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এজন্য দুই যুগ আগে গঠন করা হয় সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল বা ইইএফ। কিন্তু দীর্ঘসময় পর দেখা যাচ্ছে ফান্ডটি ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারই হয়েছে বেশি। কারণ মেয়াদ শেষ হলেও ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন না অনেক গ্ৰাহক। এমনকি আদালতে মামলা করেও আদায় হচ্ছে না ইইএফের টাকা। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ঋণ নেওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানেরই এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। 

সবশেষে গত ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেখানে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের প্রতিবেদন সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইইএফ ফান্ড থেকে ঋণ নেওয়া গ্ৰাহকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ২২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে আইসিবি। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি। কারণ, তাদের মধ্যে বিতরণকৃত ১৪০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ২২ কোটি ৯৭ লাখ। মামলার বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার  মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেনের সাড়া পাওয়া যায়নি। 

তবে আইসিবির ইইএফ ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক আল আমিন তালুকদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য এটা ছিল সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে গ্রাহকের কাছ থেকে সব টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি। ফান্ড শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭৪টি মামলা করা হয়েছে। তবে মামলা করার পর আদালত ও পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আদায় হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। টাকাগুলো আদায়ের জন্য গ্রাহকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানান তিনি।

বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে ইইএফ থেকে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা নেয় নোয়াখালী জেলার চর উড়িয়ার মান্নান নগরে নোয়াখালী গোল্ড ফুডস লি.। এ টাকায় চিংড়ি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করা হবে বলা হয়েছিল। এই প্রকল্পের অনুমোদন হওয়া অর্থে ৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকার মেশিনারিজ বিদেশ থেকে আমদানি করার কথা থাকলেও এর সপক্ষে কোনো দলিল দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। আমদানিকৃত মেশিনারিজের মান ঠিক আছে কি না পাওয়া যায়নি তার কোনো প্রমাণ। এমনকি এই প্রকল্পে দুজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের কথা থাকলেও তাদের নিয়োগের কোনো আদেশ কপিও পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবির পরিদর্শনদল প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ পায়। ওই সময় তারা উল্লেখ করেন এই প্রকল্পের ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজার থেকে চিংড়ি কিনে নোয়াখালীতে প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বেশি হওয়ার পরও এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া আইন বিরোধী বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিদিনের বাংলাদেশের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় একজন জানান, গত ৮ থেকে ১০ বছরে এখানে কোনো কাজ হতে দেখিনি। তবে নোয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নিজাম উদ্দিন জানান, করোনার সময় এটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে শুধু দারোয়ান ও পাহারাদাররাই থাকে। এটা চালু হবে কি না জানি না। এখন আমি জায়গাটার দেখভালের দায়িত্বে আছি।

ইইএফ থেকে ঋণ নেওয়া আরও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম কক্সবাজার হ্যাচারি অ্যান্ড ফিশারিজ। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার জেলার রামুতে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল হক চৌধুরীর মাছ চাষ বা পোনা উৎপাদনে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার পরও এই বিনিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি বিনিয়োগের আগে প্রকল্পে কোনো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ না করার পরও বিনিয়োগের অর্থ ছাড় করা হয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জমির দলিল, মিউটেশন ও খাজনার যেই প্রমাণাদি দিয়েছেন তা পুরোটাই ভুয়া। ইইএফ ফান্ড থেকে বিনিয়োগ করার ৮ বছর অতিক্রম করলেও সেই অর্থ এখনও ফেরত আসেনি। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেসব দলিল দেখানো হয়েছে তা বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে ইজারা নিয়েছিলেন শফিকুল হক চৌধুরী। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিবি পুনরায় প্রকল্প পরিদর্শনে যাবেন এমন তথ্য পাওয়ার পর ওই বছরের মার্চ মাসে প্রকল্পে লুট হয়েছে উল্লেখ করে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শফিকুল। যেই ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই প্রকল্পের জমির প্রকৃত মালিক। যার মধ্যে চারজন আগেই মারা গেছেন। 

প্রতিদিনের বাংলাদেশ সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা জানান, ২০০৩ সালে তাদের মতো স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তির জমি ভাড়া নিয়ে হ্যাচারি ব্যবসা শুরু করেন মোহাম্মদ শফিউল হক চৌধুরী। কিন্তু শুরুর কয়েক বছর যেতে না যেতেই হ্যাচারিটি বন্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় হ্যাচারির বিভিন্ন মামলা ও পুকুরসমূহ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। সেই সঙ্গে জমির মালিকরাও দীর্ঘদিনের বকেয়া ভাড়া না পেয়ে জমি বুঝিয়ে নিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। জমি ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চালালে মোহাম্মদ শফিউল হক চৌধুরী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। বর্তমানে শফিকুল বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনায় পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলাও রয়েছে।

এদিকে সংসদীয় কমিটির ৬৭তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ই্ইএফ থেকে যত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার মধ্যে ২৪৩টি প্রকল্পে অনিয়ম শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২৪৩টি প্রকল্পে মোট ২৭৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৯ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাকি ১৫৭ কোটি টাকা এখনও আদায় করা যায়নি।

সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণীর তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত যত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার মধ্যে উধাও হয়ে গেছে ১৮টি প্রকল্পের গ্রাহক। পরিত্যক্ত বা বদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে ৪৭টি প্রকল্প। যাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল ছয় হাজার ৯ কোটি টাকা। তবে আদায় হয়েছে ৮৬৬ কোটি। বাকি টাকার কোনো খোঁজ নেই। আংশিক উৎপাদনে আছে ৭৬টি প্রকল্প। যাদের মধ্যে বিতরণ করা হয় ৯ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে এক হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এখনও বকেয়া সাত হাজার ৪৬২ কোটি। পূর্ণ উৎপাদনে আছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ৫৭টি প্রকল্প। যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছিল সাত হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা আর আদায় হয়েছে এক হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। বকেয়া রয়েছে ছয় হাজার ১১ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে গেছে ১৮টি আইসিটি প্রতিষ্ঠান। তাদেরকে দেওয়া হয়েছে এক হাজার ২২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকার ঋণ। কিন্তু দুই যুগ পার হয়ে গেলেও আদায় হয়েছে মাত্র ১৪৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই খাত থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া এক হাজার ৭৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকার গ্রাহকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সম্ভাবনাময় আইসিটি শিল্প এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে ২০০০-০১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের মাধ্যমে ইইএফ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তহবিলের পরিমাণ। ২০০৯ সালে তহবিল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আইসিবির কাছে। গত আগস্ট পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় এ তহবিলে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে ২ হাজার ৬৩টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৯টি প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করা হয় ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। এসব ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ২০৫ কোটি টাকা এখনও আদায় হয়নি। বিধান অনুযায়ী বিতরণকৃত অর্থ ৮ বছর পরেই সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে ২২ বছর পার হয়ে গেছে। ইইএফে ব্যাপক জালিয়াতি ও মামলার সুযোগ না থাকায় অর্থ উদ্ধারে আইনের সুযোগ রেখে গত বছর ঋণ তহবিলের নাম পরিবর্তন করে এন্ট্রাপ্রেনারশিপ সাপোর্ট ফান্ড (ইএসএফ) গঠন করা হয়েছে। এই তহবিল থেকে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ২ শতাংশ সুদে ১৩টি প্রকল্পে ১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ঋণ হিসাবে বিতরণ করা হয়। যা আদায়ে এখনও সময় হয়নি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা