বাণিজ্য
হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০২ এএম
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পণ্য পাঠাতে সময় লাগত ২০ থেকে ২২ দিন। কিন্তু লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার ঘটনায় ওই রুট দিয়ে পণ্য পরিবহন স্থগিত করেছে শিপিং লাইনগুলো। তাতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য পরিবহনের রুট বদলেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্যয়ভার।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিকল্প রুটে জাহাজভাড়া বেড়েছে ৪৫ থেকে ৫৩ শতাংশ। ২০ ফুটের একটি কন্টেইনার পরিবহনে আমদানি-রপ্তানিকারকদের এখন ৫০০ ডলার বাড়তি গুনতে হবে।
জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দেশের আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়লে তার প্রভাবে স্থানীয় বাজারে ওইসব পণ্যের দামও বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দেখা দিতে পারে জটিলতা। রুট পরিবর্তন হওয়ায় এখন বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক পাঠাতে সময় বেশি লাগবে। যার প্রভাব পড়বে ক্রয়-আদেশে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা তাদের বাড়তি খরচ রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সমন্বয় করার চেষ্টা করতে পারে।
ফিলিস্তিন-ইসরাইয়েল যুদ্ধের ঘটনায় গত কয়েক সপ্তাহে হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ডজনখানেক হামলা চালায়। এর মধ্যে ভারতীয় পতাকাবাহী একটি তেলের জাহাজে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলার পর সুইজারল্যান্ডের এমএসসি, ডেনমার্কের মেয়ার্সকের মতো কন্টেইনারবাহী জাহাজ কোম্পানি লোহিত সাগরপথে জাহাজ পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ও ইকুইনার মতো কয়েকটি জ্বালানি কোম্পানিও সাময়িকভাবে সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন বন্ধ রেখেছে। ভিন্ন রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল করায় এসব জাহাজ কোম্পানি ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘটনায় ট্রানজিট ডিসরাপশন সারচার্জ (টিডিএস) নাম দিয়ে ২৭টি রুটে জাহাজভাড়া বাড়িয়েছে ডেনমার্কের মেয়ার্সক। এর মধ্যে কয়েকটি রুটে ইমার্জেন্সি কন্টিনজেন্সি সারচার্জ (ইসিএস) আরোপ করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যা ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। একইভাবে ফ্রান্সের সিএমএ ও সিজিএম গত সপ্তাহে ১১টি রুটে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
লোহিত সাগর হয়ে চলাচল স্থগিত করায় শুধু যে জাহাজভাড়া বাড়ছে তা নয়, রুট পরিবর্তন করে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যাতায়াতের কারণে এখন সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে সময়ও বাড়বে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, লোহিত সাগর হয়ে ইউরোপে জাহাজ চলাচল স্থগিত করায় এখন আগের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় বেশি লাগছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনার নিয়ে একটি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক পর্যন্ত যেতে এখন সময় লাগবে ২৮ থেকে ৩০ দিন।
জাহাজভাড়া এবং পরিবহন সময় বেড়ে যাওয়ায় দেশের তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ খুব কম কার্গো পণ্য আমদানি করে। দেশে যেই পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি হয় তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। কিন্তু বিপরীতে দেশের তৈরি পোশাকের বিরাট একটি অংশ রপ্তানি হয় ইউরোপ-আমেরিকায়। তাই তৈরি পোশাক শিল্পই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এসএম আবু তৈয়ব প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প খাত এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে। এর ওপর এখন জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতি আরও বাড়বে। এখন জাহাজের ভাড়া এবং পণ্য পরিবহনের সময়Ñ এসব চিন্তা করে যদি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেন, তাহলে আমরা সত্যিকার অর্থে চাপে পড়ব। তবে আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাহাজভাড়া ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বহন করে। কিন্তু ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তারা যদি দাম সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমরা বেকায়দায় পড়ব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মুনতাসির রুবাইয়াত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার ঘটনায় শিপিং কোম্পানিগুলো ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হবে। জাহাজভাড়া বাড়ায় এখন এক টিইইউস (২০ ফুটের কন্টেইনার) পরিবহনে ভাড়া বাড়বে প্রায় ৫০০ ডলার। সেই হিসাবে ৪০ ফুট লম্বা একটি কন্টেইনার পরিবহনে আগের চেয়ে ১ হাজার ডলার বেশি ভাড়া গুনতে হবে।
এদিকে সম্প্রতি লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। এর ফলে মেয়াসর্ক ২৪ ডিসেম্বর ওই পথ ব্যবহার করে আবারও পূর্ব-পশ্চিমে জাহাজ চলাচল শুরু করার কথা জানিয়েছে। যদিও তারা এখন পর্যন্ত ওই রুটে জাহাজ চালানোর নতুন শিডিউল ঘোষণা করেনি। তবে অন্য বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো এখনও আগের সিদ্ধান্তে অর্থাৎ বিকল্প রুটে যাতায়াতের বিষয়ে অটল রয়েছে। যেমন মেডিটারিয়ান শিপিং কোম্পানি এমএসসি কেপ অব গুড হোপ রুট দিয়েই জাহাজ চালানোর সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। ফ্রান্সের কোম্পানি সিএমএ ও সিজিএমের সিদ্ধান্তও একই। যার মানে হচ্ছে, লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চালানোর বিষয়ে বেশিরভাগ কোম্পানিই অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত।
বিকল্প রুট কেপ অব গুড হোপ
নিরাপত্তাহীনতার কারণেই লোহিত সাগরের বিকল্প রুট ভাবতে বাধ্য হয়েছে জাহাজ কোম্পানিগুলো। তার পরিবর্তে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ‘কেপ অব গুড হোপ’ রুট হয়ে যাতায়াতের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেপ অব গুড হোপ হলো সমুদ্রপথে এশিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার একটি রুট। এটি আফ্রিকার দক্ষিণপ্রান্ত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের ইউরোপীয় উপকূল থেকে এশিয়ার ভারত মহাসাগরের উপকূলে যাতায়াতের মাধ্যম।