× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাজার সিন্ডিকেটে গরিবের সর্বনাশ

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৪০ এএম

আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৫৯ এএম

বাজার সিন্ডিকেটে গরিবের সর্বনাশ

দেশে ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য এতটাই বেড়েছে যে, কিছু মানুষ চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যপণ্য কিনতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে একশ্রেণির মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা হিসাব। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবে টাকার পরিমাণ আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে। একই সময়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের ব্যাংক হিসাবে কমে এসেছে টাকার অঙ্ক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বর্তমানে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবে টাকাও বেড়েছে। মজুদদারি বন্ধ করে অসৎ ব্যবসায়ীদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের টাকা জমা থাকে মূলত পাঁচ ধরনের হিসাবে। এক. কৃষকদের ব্যক্তিগত হিসাব, দুই. কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব, তিন. আমদানি-রপ্তানিকারদের হিসাব, চার. ব্যক্তিগত হিসাব এবং পাঁচ. ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের ব্যক্তিগত হিসাব। এই পাঁচ শ্রেণির সবাই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে জড়িত।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কৃষক ও কৃষিপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আমানত কমলেও বাকি তিন ধরনের হিসাবে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যক্তিগত (হাউসহোল্ড) হিসাবে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৫৯৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ছিল এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যক্তি হিসাবে ২৯ হাজার ১৯৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার বড় একটি অংশ ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের টাকা। 

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি অনেকটা অভ্যন্তরীণ। বাজারগুলো যেভাবে প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ হওয়া উচিত, সেটা নেই। এখানে সিন্ডিকেট হয়ে যায়। গত দুই বছরের মধ্যে বাজারের এই সিন্ডিকেট দৃশ্যমান হয়েছে। তারা অ্যাসোসিয়েশন করেছে, তারা সরবরাহ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সঙ্গে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সরকারকে ট্যাকেল করতে হবে।’

আলোচ্য তিন মাসে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের হিসাবে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ হাজার ৪৫২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্পপতিদের (ব্যক্তি) হিসাবে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৭৮৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে জুন প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এছাড়া আমদানি-রপ্তানিকারকদের ব্যাংক হিসাবের টাকার অঙ্ক ২০ হাজার ৫৯২ কোটি থেকে ২০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আমদানি-রপ্তানিকারকদের হিসাবে ১২ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্যদিকে কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ১১০ কোটি। জুন মাসে কৃষকদের হিসাবে ৩২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা থাকলেও সেপ্টেম্বরে আমানত ৩১ হাজার ৪২৫ কোটিতে নেমে এসেছে। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই অবস্থা। জুন শেষে তাদের ব্যাংক হিসাবে ছিল ১৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু তিন মাসের ব্যবধানে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা কমে ১২ হাজার ১৯৭ কোটিতে নেমে এসেছে কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত।

কিন্তু বাজারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, আলু থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এই সুযোগে পকেট ভারী হচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর।

গত ২৩ ডিসেম্বর দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে সমন্বয়হীনতা ও মূল্যবৃদ্ধির চিত্র ফুটে উঠেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে। তাদের হিসাবে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও রসুনের দাম গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১২ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। মূলত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া নিত্যপণ্যের মূল্যতালিকা থেকে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারির মূল্যের সঙ্গে ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বরের মূল্যতালিকার তুলনা করে এসব তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।

বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা বিভিন্নভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। তারই অংশ হিসেবে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সীমা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’ 

তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর এখন কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লে মানুষ আগের চেয়ে কম ঋণ গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে যাদের কাছে টাকা রয়েছে, বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় তারা ব্যাংকে টাকা রাখবে। এতে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। 

এদিকে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং জুনের মধ্যে ৬ শতাংশে নামাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনে আবারও সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিক শেষে গ্রামে তফসিলি ব্যাংকের শাখাগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা নেমে এসেছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭০ কোটি ২২ লাখ টাকায়। সে অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে গ্রামাঞ্চলের ব্যাংকগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ কমেছে ৯৮ হাজার ৮৮৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এত অল্প সময়ে গ্রামে ব্যাংক আমানত প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি কমে যাওয়ার বিষয়টি এখন ভাবিয়ে তুলছে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের। তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। দেশে আহরিত রেমিট্যান্সের (প্রবাসী আয়) মূল গন্তব্যস্থল হলো গ্রামাঞ্চল। এ রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ ব্যাংকে জমা হয় আমানত হিসেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রেমিট্যান্সের পাশাপাশি গ্রামের ব্যাংকগুলোতেও আমানত ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৯০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। ২০২২ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৬৭ কোটি ২৮ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশের কিছু বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের মৌলিক উপাদানের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব সব খাতেই পড়েছে। তবে আমাদের ব্যবসা মৌলিক ভোগ্যপণ্যের নয়। আমরা যে পণ্য উৎপাদন করি, সেগুলো প্যাকেটজাত পণ্য। এগুলোর দাম বৃদ্ধি করতে অনেক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’

পণ্যের সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে পাইকারি পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য বিক্রেতাদের সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লেই পাইকারি ব্যবসায়ীদের দিকে অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয়। দাবি করা হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আসলে সিন্ডিকেট বলতে কিছু নেই। এখানে চার-পাঁচজন শিল্পপতি আছেন, যারা বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্য আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন করেন। আমাদের দেশের সরকার থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পর্যন্ত সব জনগণ তাদের ওপরই নির্ভরশীল। তাহলে কি তারা উৎপাদন করবে না? ভোগ্যপণ্য সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন আমাদের দেশের সরকারি চিনিকলগুলোতে বহু পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু কিছু চিনিকল উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে, বন্ধপ্রায়। এগুলোকে উৎপাদনে ফেরানোর জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। নতুন করে সরকারি চিনিকল, পাটকল ইত্যাদি উৎপাদনে ফিরলে দেশে পণ্যে সংকট থাকবে না। একটা সরকারি চিনিকল বিক্রি করলে সিটি বা মেঘনা গ্রুপের মতো চারটা আধুনিক চিনিকল তৈরি করা সম্ভব। তা সম্ভব না হলে বেসরকারি কোনো ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করারও পরামর্শ দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।

গোলাম মওলা আরও বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয়গুলো পণ্য প্রয়োজনীয়তার পরিসংখ্যান ঠিকমতো করতে পারে না। ফলে কোন পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদনের সক্ষমতা কতটুকু এবং কতটুকু আমদানি করতে হবে তা আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই কখনও কখনও হুট করেই পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদির দাম বেড়ে যায়। এই জায়গাটা আরও শক্তিশালী করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা