ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০১:২১ এএম
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৩৮ এএম
প্রবা ফটো
‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’ অনেক পুরোনো একটি বাংলা প্রবচন। যার অর্থ, সহজসরল প্রাণী অনেক কষ্ট করে যা উৎপাদন করে, তা হয়ে ওঠে উৎপাদনবিযুক্ত অন্য কোনো প্রাণীর আহার। বাংলার কৃষকের বাস্তব অবস্থার চালচিত্রই যেন ফুটে উঠেছে এ প্রবচনের মধ্য দিয়ে। শীতের মৌসুম শুরু হয়েছে। বাজারে উঠতে শুরু করেছে শীতকালীন শাকসবজি ও মসলাজাতীয় পণ্য। এসব পণ্যের বাজারদর শুনেই নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। অথচ এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ঘরে তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরের ব্যবধানে বেশ কিছু কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে আড়াইগুণ বা আড়াইশ শতাংশ। এসব পণ্যের উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার পরও তা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে বেশ চড়া দামে। যদিও ওই যৎসামান্য উৎপাদন ব্যয় ঘরে ফিরিয়ে আনতেই উৎপাদক কৃষকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে এসব পণ্যের খুচরা বিক্রির দাম গুনতে সাধারণ মানুষজনেরও কষ্ট হচ্ছে।
সম্প্রতি আলু, ডিম ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি ক্রেতাদের নাভিশ্বাস বাড়িয়েছে। অথচ উৎপাদন পর্যায়ে পেঁয়াজের ব্যয় হচ্ছে ৩৩ টাকা ৪ পয়সা। যার বর্তমান দাম ১৮০-২০০ টাকা। রসুনের উৎপাদন পর্যায়ে ব্যয় হচ্ছে ৫০ টাকা ৫২ পয়সা। অথচ এর বর্তমান বাজারদর ২৪০-২৬০ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন পর্যায়ে পণ্যের ব্যয়, কৃষকের বিক্রয়মূল্য, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোক্তা-ক্রেতাদের কাছে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য দেখা দিয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ডিএএম) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণ এবং সরেজমিনে বাজার পর্যবেক্ষণ করে এ চিত্র উঠে এসেছে।
ডিএএমের হিসাবে গত এক বছরের মধ্যে দেশি পেঁয়াজের দাম ২০০ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২৮৮ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে দেশি রসুনের দামও। পণ্যটির দাম ৯১ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও আমদানি করা চায়না রসুনের দাম বেড়েছে ৬৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আবার টিসিবির হিসাবে দেশি পেঁয়াজ ১৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজে বেড়েছে ২৫৮। দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ২৪০ শতাংশ; আমদানি করা চায়না রসুনের বেড়েছে ৯৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
টিসিবির তালিকাভুক্ত ২৭ পণ্যের বাজারদর
টিসিবি একক পণ্য হিসেবে ২৭টি পণ্যের প্রতিদিনের বাজারদরের তালিকা দিয়ে থাকে। এসবের মধ্যে ২৫টি পণ্যের দামই গত বছরের চেয়ে বেড়ে গেছে। কোনো কোনোটির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যেমন আলুর দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ২২ থেকে ৩৫ টাকা। যার বর্তমান দাম ৪৫-৫৫ টাকা। পণ্যটির দাম বেড়েছে ৭৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশি পেঁয়াজের দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ৪৫-৫৫ টাকা। বর্তমানে যার দাম ১০০-১৭৫ টাকা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বেড়েছে ১৭৫ শতাংশ। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকা। বর্তমানে তা ১৪৫-১৬০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ২৫৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। দেশি রসুন ছিল ৭০-৮০ টাকা। বর্তমানে তা ২৫০-২৬০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ২৪০ শতাংশ। আমদানি করা রসুন গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকা। বর্তমানে যার দর ২১০-২২০ টাকা। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৯৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
পেঁয়াজ, রসুনের সঙ্গে বেড়েছে মসলাজাতীয় পণ্য আদার দামও। দেশি আদার দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ১২০-১৫০ টাকা। বর্তমানে এর দাম ২৫০-৩০০ টাকা। পণ্যটির দাম বেড়েছে ১০৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। আমদানি করা আদা ছিল ১০০-১৬০ টাকা। বর্তমানে তা ২০০-২৬০ টাকা। বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। জিরা প্রধানত আমদানি করা হয়ে থাকে। এই জিরার দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ৫০০-৫৭০ টাকা। বর্তমানে এর দাম ১০০০-১১০০ টাকা। পণ্যটির দাম বেড়েছে ৯৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। একইভাবে দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যের।
ডিএএমের তালিকাভুক্ত ৩০ পণ্যের বাজারদর
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম) ৩০টি পণ্যের উৎপাদন ব্যয়, খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রির একটি তালিকা প্রতিদিন দিয়ে থাকে। ওই তালিকা অনুযায়ী এক কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ৩৩ টাকা ৪ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সে অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে এর যৌক্তিক মূল্য দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা। কিন্তু গত ১২ ডিসেম্বর পণ্যটি পাইকারি পর্যায়েই বিক্রি হয়েছে ৭৫-১৮০ টাকা কেজিতে। গত বছর একই সময়ে এর দাম ছিল ৪৫-৫৫ টাকা। সে হিসাবে পণ্যটির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। ডিএএমের হিসাবে রসুন ও আদার উৎপাদন ব্যয় ৫০ দশমিক ৫২ টাকা, খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য হতে পারে ৬৫ টাকা কেজি। কিন্তু বর্তমানে রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৭০-২৪০ টাকায়; গত বছর যার মূল্য ছিল ৭০-১০০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ২০৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আদার দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ১১০-১৮০; বর্তমানে তা ২০০-২৮০ টাকা। দাম বেড়েছে ৬৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।
চলতি বাজারদর
গত রবিবার রাজধানীর খুচরা বাজারে মানভেদে কেজিপ্রতি বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৬০ টাকা, পাকা টমেটো ৮০ থেকে ৯০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, গাজর ৭০ থেকে ৮০ টাকা, পেঁপে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এবং পাতা ও ফুলকপি প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
তেজগাঁও কলমিলতা বাজারের মো. আরাফাত হোসেন জানালেন, দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১৬০ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ১২০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি দরে। আমদানি করা রসুনের দাম কেজিপ্রতি ২৫০/২৬০ টাকা।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে মুরগির দাম বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় এবং সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হালিপ্রতি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ৫ টাকা বেড়ে ৩৫ টাকা ও ডজন ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে ১৪৮ টাকা হয়েছে। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। পাঁচ কেজি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম হয়েছে ২০ টাকা বেড়ে ৮৪৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটারে বেড়েছে অন্তত ৪ টাকা। আলু কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে নতুন আলু ৬০ থেকে ৭০ টাকায় এবং পুরোনো আলু ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উৎপাদক ও ভোক্তাদের অভিমত
ধামরাইয়ের চৌঠাইল গ্রামের কৃষক মো. আব্দুর রহমান ও মোবারক হোসেন জানান, ঢাকায় যখন এক কেজি টমেটোর দাম ১২০ টাকা, তখন তারা সেই টমেটো পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন। ঢাকায় লালশাকের আঁটির দাম সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা হলেও তাদের প্রতি আঁটি বিক্রি করতে হয় ৫ টাকা করে। তারা বলেন, এসব পণ্য উৎপাদনে নিজের শ্রম ও সময়ের মূল্য কখনও যুক্ত করা হয় না। তারপরও কৃষিপণ্যের দাম যতই বাড়ুক না কেন, লভ্যাংশের খুব কম অংশই কৃষকের ঘরে আসে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আগে একজন ক্রেতা যে দামে পণ্য কিনতেন, কৃষক পেতেন সেই দামের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে গেছে। মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভের সুবিধা পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, কৃষককে সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই কেবল এর সমাধান হতে পারে। সেক্ষেত্রে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের বিষয় চলে আসবে। তা ছাড়া কৃষকরা দলগতভাবে চাষাবাদ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে কৃষক বিক্রি হওয়া পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পাবেন।