জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:১৮ পিএম
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৬ পিএম
ব্যাংক খাতের সংস্কারে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ, মালিকদের শেয়ার, মূলধন সংরক্ষণ ও খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় দেশের ব্যাংকগুলোকে চারভাগে ভাগ করা হবে। এতে যেসব ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ হিসেবে বিবেচিত হবে তারা নতুন করে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের যোগ্যতা হারাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, কাঠামোভিত্তিক এমন দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে ১৩টি ব্যাংক। সংস্কারের নতুন উদ্যোগের ফলে এই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের যোগ্যতা হারাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন-এনপিএল (খেলাপি ঋণ) ৮ শতাংশের নিচে, তাদেরকে ক্যাটাগরি-১ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ৮ শতাংশের বেশি, অথচ ১১ শতাংশের কম হলে ক্যাটাগরি-২, যারা ১১ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে তাদের ক্যাটাগরি-৩। এটি ১৪ শতাংশের বেশি হলে ক্যাটাগরি-৪ বা বেশ খারাপ হিসেবে বিবেচিত হবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হিসাব অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি ১৩টি ব্যাংকের এনপিএল বা খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ১৪ শতাংশের বেশি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৬ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বিডিবিএল-এর ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৪ শতাংশ। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ।
এ ছাড়া বেসরকারি এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩২ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৬৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম মূলধনের অনুপাত অবশ্যই ৬ শতাংশ থাকতে হবে। যাদের মূলধনের অনুপাত সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ থাকবে তাদেরকে ক্যাটাগরি-১ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ এর মধ্যে যারা থাকবে তারা ক্যাটাগরি-২-এ পড়বে, ৩ থেকে সাড়ে ৪ এর মধ্যে যারা, তারা পড়বে ক্যাটাগরি-৩-এ। মূলধনের অনুপাত ৩ শতাংশের নিচে থাকলে ক্যাটাগরি হবে ৪, অর্থাৎ তারা সবচেয়ে খারাপ ব্যাংক বলে গণ্য হবে।
যেসব ব্যাংক ক্যাটাগরি-২-এ থাকবে তারা লভ্যাংশ দিতে পারবে না। পরিচালন ব্যয়ও ৫ শতাংশের বেশি করতে পারবে না তারা। ক্যাটাগরি-৩-এ থাকা ব্যাংক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ৫ শতাংশের বেশি বাড়াতে পারবে না এবং পরিচালন ব্যয় থাকতে হবে ৩ শতাংশের মধ্যে। ক্যাটাগরি-৪-এ থাকা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নতুন আমানত সংগ্রহ করতে এবং কোনো ঋণ দিতে পারবে না। ক্যাটাগরি-১ এর ক্ষেত্রে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই।
সূত্র আরও জানায়, আগামীতে চারটি ক্যাটাগরিতে ব্যাংকগুলোর মান নির্ধারণ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ রেশিও, মালিকদের শেয়ার রেশিও এবং মূলধন সংরক্ষণসহ খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করা হবে। এতে করে মন্দ বা খারাপ মানের ব্যাংক সহজে চিহ্নিত করা যাবে। খারাপ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নতুন আমানত সংগ্রহ ও কোনো ঋণ দিতে পারবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ‘দ্রুত সংশোধনমূলক পদক্ষেপ (পিসিএ)’ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নের নির্দেশনা জারি করেছে।
ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে সংশোধনীমূলক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব ধরনের দেশি ও বিদেশি ব্যাংকের ওপর পিসিএ বাস্তবায়ন হবে। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে ওইসব ব্যাংককে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে তা সবচেয়ে ‘দুর্বল’ বা ‘খারাপ’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
পিসিএ নিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যাংকের মানোন্নয়নে পিসিএ’র আওতায় ‘ডিরেক্টিভস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-ডিওবিবি বা ডব’ ইস্যু করা হবে। ব্যাংকের দুর্বলতা কাটাতে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে একীভূত করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকের সংকট উত্তরণে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের আলোকে নতুন করে সংশোধনী পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হবে। যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পূর্ব নির্ধারিত পর্ষদ সভায় পরিচালকদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংক সংশোধনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেওয়া পদক্ষেপ নিজেরাই বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য থাকবে। পিসিএ শুরু করার পরে সংশোধনমূলক নির্দেশক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা নামে জারি করা হবে। ব্যাংকের অবনতিশীল আর্থিক ও পরিচালন সূচক অবস্থার স্বাভাবিক উন্নতি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে একটি গ্যারান্টি প্রদান করতে হবে।
ক্যাপিটাল টু রিস্ক (ওয়েটেড) অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) হচ্ছে একটি ব্যাংকের মূলধনের সঙ্গে ব্যাংকটির রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট এবং বর্তমান ঋণের অনুপাত। যেসব ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা (সিআরএআর) ১০ শতাংশ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের মধ্যে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-১ হিসাবে বিবেচনা হবে। যাদের সিআরএআর ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-২, ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে যারা থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-৩ এবং যাদের ৫ শতাংশের নিচে থাকবে তাদের ক্যাটাগরি-৪ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে এখন বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। সুশাসনের ঘাটতি মেটাতে পারলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকার, গ্রাহক ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারল্য সংকট, ঋণের গুণগত মান, খেলাপি ঋণ, পরিচালকদের বেপরোয়া ঋণগ্রহণ এসব সমস্যা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে কমে যেতে বাধ্য।’
সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে ব্যাংকগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন (ক্যাপিটাল) রাখতে হয়। এর বাইরে কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে সেটিতে মূলধনও বেশি রাখতে হয়। ব্যাসেল গাইডলাইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদও বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। ভালো ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম হিসাব করা হয়। আবার খারাপ বা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ধরনের সম্পদকে কেন্দ্র করে কোন ব্যাংক কী পরিমাণ মূলধন রাখবে তা নির্ণয় করা হয়।
ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী যেকোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর সঙ্গে আপৎকালীন সুরক্ষা মূলধন (ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার-সিসিবি) হিসেবে আরও আড়াই শতাংশ মূলধন রাখার বিধান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যাংকের খেলাপি বা মন্দ ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ১৫টি ব্যাংক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি।