জোনায়েদ মানসুর
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:০১ পিএম
ফাইল ফটো
তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে ৭ম চূড়ান্ত বোর্ড সভা আজ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিকালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সভাটি বেলা ১১টায় নিম্নতম মজুরি বোর্ড সভায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অনিবার্য কারণবশত স্থান পেছানো হচ্ছে। ওই বৈঠকে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত গেজেট হবে। ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা পরিবর্তন না হওয়ার আভাস মিললেও অন্য গ্রেডগুলোতে বেশকিছু পরিবর্তন আসার কথা রয়েছে।
ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা পরিবর্তনের কোনো আভাস আছে কী না জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখনও জানিনা ঠিক, কিছু পরিবর্তন হতেও পারে, নাও হতে পারে। কোনো আভাস দেওয়া যাবে না। সভার পরে জানান যাবে। ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা পরিবর্তন না হওয়ার আভাস মিললেও অন্য গ্রেডগুলোতে বেশকিছু পরিবর্তন আসার কথা রয়েছে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘১১ নভেম্বর মজুরির খসড়া গেজেট হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি বিষয়ে ৭ম চূড়ান্ত বোর্ড সভা আজ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিকালে হচ্ছে। ওই বৈঠকে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত গেজেট হবে।’
ন্যূনতম মজুরি বাড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ন্যূনতম মজুরি সরকার ঘোষণা করেছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এটা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এটা বাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। দাবি তো সবাই করতে পারে।’ অন্য গ্রেডগুলোতে কোনো পরিবর্তন আছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা দেখবো, সভায় বসবো। উভয় পক্ষ থেকে আপত্তি জমা পড়ছে। সেগুলো আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে আপনাদের জানাবো।’
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তিনটি সংগঠন খসড়া গেজেটের ওপর আপত্তি ও সুপারিশ জানিয়েছে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ এ কথা স্বীকার করেছেন। তবে সুনির্দিষ্টভাবে ওই তিনটি সংগঠনের নাম জানাননি তিনি। সচিব নাম প্রকাশ না করলেও যে তিনটি সংগঠন ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আপত্তি করেছে সেগুলো হলো- গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধি বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘এর চেয়ে বেশি মালিকরা বাড়াবে না। তবে আরও যে চারটি গ্রেড আছে, সেখানে যে অনুপাতে মজুরি বাড়ানো হয়েছে তা নিয়ে মজুরি বোর্ডে আমি আমার আপত্তি জানাব। সেখানে অন্য গ্রেডগুলোর বিষয়টি তুলে ধরব। আশা করি তা বিবেচনা করা হবে।’
এরআগে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ১২ নভেম্বর পোশাকশ্রমিকদের জন্য ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির খসড়া কাঠামো প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন গ্রেডে পোশাকশ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ৫৪-৫৬ শতাংশ। মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৫৪ শতাংশ। ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা হলেও শিক্ষানবিশ শ্রমিকের মজুরি হবে ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। আর শিক্ষানবিশকাল হবে সর্বোচ্চ ৬ মাস। খসড়া মজুরির ওপর ১৪ দিন পর্যন্ত লিখিত আপত্তি বা সুপারিশ নেবে মজুরি বোর্ড। এদিন ১১ শ্রমিক সংগঠনের জোট ‘মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলন’–এর নেতারা মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লার কাছে খসড়া মজুরিকাঠামোর ওপর লিখিতভাবে আপত্তি জানান। এতে তারা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার ও মোট মজুরি মধ্যে মূল বেতন ৬৫ শতাংশ, সব গ্রেডে সমানহারে মজুরি বৃদ্ধি, প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্টসহ সাত দফা দাবি জানান।
আইএলওর বিবৃতি : তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চূড়ান্ত হওয়ার এক সপ্তাহ পর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৫ নভেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে সংস্থাটি বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণপ্রক্রিয়া নির্ধারণের ওপর জোর দেয়। বিবৃতিতে আইএলও বলেছে, তৈরি পোশাক খাতে মজুরি নিয়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে। আরও প্রাণহানি ও জীবিকার ক্ষতি এড়াতে সব পক্ষকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গঠনমূলক সংলাপ ও আলোচনায় অংশ নিতে আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জোরালোভাবে উৎসাহ দিচ্ছি। এটি শ্রমিকের মানসম্মত জীবনযাত্রার পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসাকে টেকসই করতে নিশ্চয়তা দেবে। বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় মজুরি নীতি ও মজুরি নির্ধারণের জন্য একটি প্রমাণভিত্তিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে মনে করে আইএলও। তারা বিবৃতিতে বলেছে, ‘এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই।’
এর আগে গত ১১ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে খসড় প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রালয়। আগে সাতটি গ্রেড থাকলেও বর্তমানে তা কমিয়ে পাঁচটি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন গ্রেড-৫-এ ন্যূনতম বেতন ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ৬৭০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৩৩৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্যভাতা রাখা হয়েছে ১২৫০ টাকা। এ ছাড়া গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ গ্রেডের মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। এই গ্রেডে মাসিক মূল মজুরি বা বেতন ধরা হয়েছে ৮২০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ৪১০০ টাকা, চিকিৎসা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ৪৫০ টাকা ও খাদ্য ভাতা ১২৫০ টাকা। সব গ্রেডের মূল মজুরি মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কম বেশি হলেও বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, খাদ্য ও যাতায়াত ভাতা একই। আর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরির মূল বেতনের পার্থক্য রাখা হয়েছে মাত্র ২২৫০ টাকা।৭ নভেম্বর রাজধানীর তোপখানা রোডে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের দর কষাকষির ভিত্তিতে এই মজুরি নির্ধারণ করে মজুরি বোর্ড। পরে একই দিন সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান নতুন মজুরি ঘোষণা করেন।
নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনার আহ্বান টিআইবির : তৈরি পোশাক খাতের ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির হার শুভঙ্করের ফাঁকি বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ইতোমধ্যে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনার জন্য চিঠি দিয়ে মজুরি বোর্ডকে আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। ২১ নভেম্বর গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মোট মজুরি ৫২ থেকে ৫৬ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে বৃদ্ধির হার ২৫ থেকে ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাছে নিজেদের এমন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে টিআইবি। নিম্নতম মজুরি বোর্ড চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠি ও বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে— বছরে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময়মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকদের মজুরি প্রকৃত অর্থে ৩০ শতাংশও বাড়েনি।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে পাঠানো চিঠিতে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত নিম্নতম মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে। সে হিসাবে পূর্ববর্তী গ্রেড সাত বা নতুন প্রস্তাবিত গ্রেড পাঁচে ২০২৩ সালে মূল মজুরি ন্যূনতম ৫ হাজার ২৩২ টাকা ৭৫ পয়সা হওয়ার কথা। এই গ্রেডে প্রস্তাবিত নতুন মূল মজুরি ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ এই গ্রেডে মূল মজুরি ৬৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বেড়েছে ২৮ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। গ্রেড চারের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। একইভাবে গ্রেড তিন, দুই ও এক-এর ক্ষেত্রে মূল মজুরি প্রকৃত বৃদ্ধি পাবে ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ২৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। প্রতিবছর মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বাড়লে ২০২৩ সালে এসে নতুন প্রস্তাবিত গ্রেড পাঁচে ন্যূনতম মোট মজুরি হওয়ার কথা ৯ হাজার ৬৯৯ টাকা ১৩ পয়সা। নতুন প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী— এই গ্রেডে সর্বমোট মজুরি প্রস্তাব করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ, ৫৬ শতাংশ সর্বমোট মজুরি বাড়ানো হয়েছে বলা হলেও মূলত বেড়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ ৮৮ শতাংশ। একইভাবে গ্রেড চার, তিন, দুই ও এক- এর ক্ষেত্রে মোট মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে মাত্র ২৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ২৫ শতাংশ ৫৮ শতাংশ, ২৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সর্বমোট মজুরি এই গ্রেডে ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে বলা হলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সর্বমোট মজুরি বৃদ্ধির হার মাত্র ২৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় গ্রেড চার, তিন, দুই ও এক-এ প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২২ দশমিক ৮০, ২২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ। অ
পরদিকে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, মূল মজুরি সর্বমোট মজুরির ৬০ শতাংশ ধরা হলেও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী— সেটা ৫৩ থেকে ৫৬ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে বছর প্রতি ৫ শতাংশ মূল মজুরি বৃদ্ধির সুযোগ রাখা হলেও সামনের দিনে তুলনামূলক কম মজুরি বাড়বে শ্রমিকদের। যা এই মজুরি কাঠামোর বড় দুর্বলতা।