জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:১৮ পিএম
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংক। ফলে ২৮ হাজার ৮৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো। যেসব ব্যাংক ঘাটতিতে আছে সেগুলো হলোÑ ন্যাশনাল ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংক।
প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংক খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত। কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল। করপোরেট সুশাসন ও ব্যাংকিং ব্যবসার ভিত্তি মজবুত না হওয়ার কারণে এ সংকটের উৎপত্তি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ২৭১৯ কোটি টাকা ঘাটতি বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ৫০ শতাংশ সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে।
তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে এ ব্যাংকটি বেশ আলোচিত। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায়ে তারা বেশ পিছিয়ে। সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি ৮১ লাখ। কিন্তু ব্যাংকটি ১ হাজার ৮৮৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাই ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। কারণ সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৬০০ কোটিতে পৌঁছেছে। তথ্যমতে, ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে ব্যাংকটির ঋণ; যা ব্যাংকের মোট বিতরণের ২৪ শতাংশেরও বেশি। প্রভিশন ঘাটতিতে এরপরই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ১৯৮ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৪২ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৩৯৯ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৩৩৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩৪ কোটি এবং মধুমতি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৯০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) তা গ্রহণ করে না। তার মানে এ হিসাবের চেয়ে খেলাপি ঋণের মাত্রা অনেক বেশি। এখানে পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব নেই। আদালতে অনেক খেলাপি ঋণ স্থগিত করা আছে, যার হিসাবও আসে না। এগুলো যোগ করলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক বেশি হবে। তা ছাড়া অন্যায় ও দুর্নীতি এখন ব্যাংক খাতকে ঘিরে ধরেছে। তারই প্রমাণ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দেওয়ার কারণে এখন ব্যাংকগুলো আর ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে পারছে না।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সামান্য কমেছে। তবে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
জানা গেছে, রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ জুনে ছিল ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, যা কমে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৫৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ১৯৭ কোটি থেকে বেড়ে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায় উঠেছে।