জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৩ ০০:২৮ এএম
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৩ ১০:৪৭ এএম
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে জোর তৎপরতার পরও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। দিন দিন বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ কমাতে বিপুল পরিমাণে পুনঃতফসিল শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। তবুও খেলাপির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) ৬৪২ কোটি টাকা কমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। গত জুন শেষে এ অঙ্ক ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুন শেষে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণে ঋণখেলাপি মানে শ্রেণীকরণ হয়। তখন মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। ফলে ব্যাপক চাপে পড়ে আর্থিক খাত। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে খেলাপি কমাতে উদ্যোগী হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে এবং পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে খেলাপি কমাতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানে খেলাপি না কমায় ঋণ পুনঃতফসিলের কৌশল নেয় ব্যাংকগুলো। তবুও হুহু করে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ তিন মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে ব্যাংক খাতের বড় দুই সমস্যা। ব্যাংক খাতে প্রধান এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় নয়। বরং পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেলাপি নামে সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে রেগুলেশন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগেরও পরামর্শ তাদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রান্তিকটিতে দেশের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণ।
আর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে ৬ মাসের ব্যবধানে সবশেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
অপরদিকে ডলার সংকটে পড়ে আইএমএফের ঋণ নেয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার বা ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেয়েছে দেশ। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের কথা রয়েছে ডিসেম্বরে। কয়েক ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণও ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার শর্ত জুড়ে দেয়। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সব শেষ প্রতিবেদন মতে, খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে এলো, অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। তবে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের শর্ত মতে, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে আইএমএফের হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। মূলত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান না থাকায় খেলাপি বাড়ছে বলে মত অনেকের। একই সঙ্গে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
এর আগে বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছিলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরও ভূমিকা নিতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আর কঠোর হতে হবে। খেলাপি কমাতে না পারলে সেসব ব্যাংকের শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বন্ধে আমাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপও নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। খেলাপির যে চিত্র উঠে এসেছে প্রকৃত চিত্র এটা না। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ, আরও বড় হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়া হলো, অন্য সময়ও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। মোট ঋণের কিছুটা পরিশোধ করলেই আর খেলাপি হচ্ছেন না, এমন সুবিধার পরও সুফল কতটুকু?’
ড. জাহিদ আরও বলেন, ‘গ্রাহককে ঋণ পরিশোধে বার বার সুযোগ দেওয়ার পরও কোনো সুফল আসছে না। যে রেগুলেশন আছে সেটা কঠোরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না, কঠোরভাবে করতে হবে। ঋণ বিতরণ ও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে একই চোখে দেখতে হবে। এক কথায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। একদিকে ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় হচ্ছে না, আবার বিতরণও হচ্ছে এভাবে খেলাপি কমবে না।’