জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:০৭ পিএম
ফাইল ছবি
যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক পেতে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্যানেল গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজন অনুযায়ী এই প্যানেল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম সুপারিশ করবে সংস্থাটি। কারণ একজন এমডির মেয়াদ শেষ হলেই শুরু হয় বিপত্তি। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন কেউ এমডির দায়িত্ব নিতে চান না। আবার পাওয়া গেলেও এমডি হিসেবে তাকে পছন্দ হয় না পরিচালনা পর্ষদের। এই সমস্যার সমধানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আর্থিক খাতের উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া খেলাপি ঋণ নিয়েও সংকটে রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। গত জুনের শেষে দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। এই খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে এখন মোট ঋণের প্রায় ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বা প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। এই খাতে জুনের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মার্চের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি, অর্থাৎ বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকায়, যা গত মার্চে ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৩ মাসে ঋণ বেড়েছে ৮৮৫ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেই। চলতি দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে নিচের কর্মকর্তাদের। যারা নতুন এমডি নিয়োগের আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করবেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে এমডি নেই সেগুলো হলোÑ ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লি. (বিআইএফসি), ইউএই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লি. ও জিএসপি ফাইন্যান্স।
এমডি না থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটের তথ্যেও প্রমাণ মিলেছে। বর্তমানে এফএএস ফাইন্যান্সের এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমডি মো. এ এফ সাব্বির রহমান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মশিউর রহমান, বিআইএফসির এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মো. আনওয়ারুল্লাহ সাদেক, ইউএই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন এম এম মোস্তফা বিলাল, জিএসপি ফাইন্যান্সের এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মো. জিল্লুর রহমান এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের এমডির চলতি দায়িত্ব পালন করছেন এ এন এম গোলাম সাব্বির।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং এটা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে আমরা একটি প্যানেল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাতে করে খাতটি দ্রুত এমডি খুঁজে পায়। এখান থেকে ভালো ফল আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাতই এখন তার জের টানছে। পি কে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিলÑ এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো খাতে।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশের বেশি, সেগুলো হলোÑ পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রতিষ্ঠানে মালিকানা আছে পি কে হালদারের। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ টাকা তিনি নামে-বেনামে তুলে নিয়েছেন, যা এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, বাস্তবতা হলো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চলে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও জানা গেছে, এর মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আস্থা অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাকিদের অবস্থা কেন নড়বড়ে হলো, তা নিবিড়ভাবে পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। একই সঙ্গে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। মানুষ সঞ্চয় করে মূলত লাভের আশায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রত্যাশিত লাভ তো দূরের কথা, আমানতকারীদের আসলের ঘরেই টান পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকার অনুমোদিত এসব নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে; একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি অর্থনীতির এক দুষ্ট ক্ষত। এ ঋণের বড় অংশই ইচ্ছাকৃত। মালিক ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে এই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত। চিন্তার বিষয় হলো, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের টাকা আদায়ে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তার মতে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও জালিয়াতি রোধ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি।