× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে

এম আর মাসফি

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৬ এএম

আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১১:১৫ এএম

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো উদ্বোধন হয়েছে, একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ এবং গ্রেস পিরিয়ড শেষে শুরু হচ্ছে ঋণ পরিশোধের পালা। গত অর্থবছরে যেখানে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছিল, সেখানে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। আগামী অর্থবছরে এ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে আরেকটি চাপ তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৬ সালের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নেওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে। এতে ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও অনেকটা বাড়বে।

ইআরডির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঋণের আসল পরিশোধ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর সুদ-আসল পরিশোধ করতে হবে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে সুদ-আসল পরিশোধ করতে হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা এরপরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, এসব ঋণের টেকসই হওয়াটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের এই বৃহৎ পরিসরের প্রকল্পগুলোর সুফল আদায় এবং স্থানীয় উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সক্ষমতার ওপর। গত অর্থবছর থেকে আর্থিক হিসাবে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেটি আগের মতো উদ্বৃত্তে আনার পথে ঋণের আসল পরিশোধ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একের পর এক বড় ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার কারণে আর্থিক হিসাবে আসল পরিশোধ আগামীতে বাড়তেই থাকবে। তারা বলছেন, ঋণের আসল পরিশোধের চাপ মোকাবিলায় সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অর্থছাড় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। তবে আগামী বছরগুলোতে অর্থছাড় বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।

ডলার সংকটের এই মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ অর্থনীতিতে বড় একটি চাপ তৈরি করছে। সরকার কি ঋণ নিয়েই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করলে তো ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে ঋণগুলোর ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ ব্যবহার করে রিটার্ন যাতে সময়মতো পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে তো বৈদেশিক মুদ্রাই লাগবে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য পলিসিগুলো ঠিক রাখা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রা না এলে তো পরিশোধে চাপ পড়বেই।’

সূত্রমতে, গত অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থছাড় কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। চলতি অর্থবছরের চলমান প্রকল্পগুলোতে ঋণছাড়ের তথ্যও খুব বেশি সুখকর নয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরÑ তিন মাসে যে পরিমাণ ঋণ ছাড় হয়েছে। তার অর্ধেকের বেশি চলে গেছে পরিশোধে। এদিকে ঋণছাড়ের পরিমাণও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি ঋণে তেমন সমস্যা না হলেও স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলোয় চাপ পড়বে। বড় বিষয় হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টরে শর্টটার্ম লোন অনেক বেশি। এগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলেও তাতে তো ডলার লাগবে। এখানে ডিফল্টার হলে তো চলবে না। এখন নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১০ বার চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়াই উচিত না। এগুলোর গ্রেস পিরিয়ড কম, সুদ বেশি।’

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এই ঋণের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকে এ ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ১৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২৭ সাল থেকে রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নেওয়া ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ শুরু করবে বাংলাদেশ। ২০ বছর মেয়াদের এ ঋণের জন্য প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে। ওই একই সময়ে মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণের আসল পরিশোধও শুরু হবে। তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে। এর ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে আসল পরিশোধে আরও বড় উল্লম্ফন হবে।

ইআরডির সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণছাড় কমেছে ১৭০ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৯৭ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তা ছাড় হয়। অথচ গত অর্থবছর ছাড় হয় মাত্র ৯২৭ কোটি ডলার। এক অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার ছাড় এতটা কমার ঘটনা আর কখনও ঘটেনি।

এদিকে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাত যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, তার চেয়ে ৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ গত ৯ মাসে ১৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। একই সময়ে সুদ ও মূল ঋণ পরিশোধ করেছে ২৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত বছরে পরিশোধের চেয়ে ঋণের পরিমাণ কিছুটা বেশি ছিল। ২০২২ সালে বেসরকারি খাত ৩৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পেয়েছে। একই সময়ে সুদসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় মেটাতে খরচ হয় ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে রপ্তানি হয় ৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১২ দশমিক ৯৩ কোটি ডলার।

এদিকে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়েও বাড়ছে না রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরে ছিল ২৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত বছরে রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও তা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম। এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৬ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত অর্থবছরে একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।

অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ও রেমিট্যান্স কমছে, পাশাপাশি রপ্তানি আয়েও তেমন সাফল্য নেই। আগামী দুই বছরের মধ্যেই বছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ হবে তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেহেতু রপ্তানি, রেমিট্যান্স সেভাবে বাড়ছে না। তাহলে তো ঋণ করেই পরিশোধ করতে হবে। সামনে আমাদের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। বিদেশে ঋণ পরিশোধের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে এবং সামনে আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমাতে হবে। রপ্তানি আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা