প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৪৩ পিএম
মূল্যস্ফীতির চাপ, আর্থিক সংকট, ব্যাংকে মুনাফা কম ও বিনিয়োগে নানা শর্তের কারণে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সে হারে নতুন ক্রয় বা বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ কারণে গত তিন মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় এ খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ১ হাজার ২৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আশাবাদী পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। জানুয়ারিতে তা ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। সেপ্টেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে, যা আগস্টে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৮৯৩ কোটি ৬৪ টাকা। সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর সেপ্টেম্বরে এ খাতে সরকারের নিট ঋণ (ঋণাত্মক) দাঁড়িয়েছে ১৪৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেওয়ার চেয়ে আগের সুদ-আসল পরিশোধ করেছে বেশি।
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা প্রদান করে সরকার। মেয়াদপূর্তির পর বিনিয়োগকৃত অর্থও ফেরত প্রদান করা হয়। প্রতিমাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ২২ হাজার ৯২১ কোটি ২ লাখ টাকা। মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর তিন মাসে সরকারের নিট ঋণ (ঋণাত্মক) দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণের চেয়ে পরিশোধের পরিমাণ বেশি।
গত অর্থবছরে একই সময় নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ধারাবাহিক কমছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ঠিক করছে সরকার; যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। গেল অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৭ হাজার ১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র জমা বা বিক্রি করেছিল। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি ৩২ টাকা। সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট ঋণ ছিল ৩৯৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।
গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে জুন ১২ মাসে ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮৪ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ২৯৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
সঞ্চয়পত্র-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অতিমাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে গত দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়। যার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে নেমে আছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে সরকার।
গত পাঁচ অর্থবছরে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার। পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ এ নিট ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ নেয় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর নেওয়া হয় ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার।
গেল অর্থবছর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডেটাবেজ তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনও তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।