আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহ
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৪১ পিএম
গৌরীনাথপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে ড্রাগন ফলের পাইকারি বাজার। প্রবা ফটো
গৌরীনাথপুর ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম। স্থানীয় কৃষকরা আম, পেয়ারা, সবজি, ধান এসব আবাদ করে এলেও ২০১৫ সালের দিকে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেন। চাহিদা বাড়ায় ড্রাগনের চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি বাড়ির উঠানে। ফলে গ্রামটি ড্রাগন গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
কৃষিপ্রধান ঝিনাইদহে গত দুই বছরের ব্যবধানে ড্রাগন চাষ বেড়েছে আট গুণ। জেলার ৮৪২ হেক্টর জমিতে এ ফলের চাষ হচ্ছে, যেখান থেকে উৎপাদন হয়েছে ৫৩৮ কোটি টাকার ফল। অথচ দুই বছর আগেও মাত্র ১৪১ হেক্টর জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ হতো।
কৃষকদের মতে, গৌরীনাথপুর গ্রামে গড়ে উঠেছে ড্রাগন ফলের পাইকারি বাজার। প্রতিদিন এখান থেকে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ড্রাগন ফল কেনাবেচা হয়। মাসে কেনাবেচা হয় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ড্রাগন ফল। সপ্তাহের সাত দিনই বসে এ বাজার। সারা দেশের পাইকারদের ভিড়ে দিনভর জমজমাট থাকে আড়তগুলো। বাজারে শুধু ঝিনাইদহ নয় যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরাও ড্রাগন ফল বিক্রি করতে আসেন। আর চুক্তিবদ্ধ শতাধিক কৃষকের ফল যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে।
গৌরীনাথপুরের কৃষকরা জানান, এই ফল চাষে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়, খুবই লাভজনক, জৈব সার দেওয়াসহ খরচ কম। অনেক তরুণ-বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে এ ফলের চাষে।
গৌরীনাথপুরসহ এ অঞ্চলে হাজার হাজার টন ড্রাগন ফলের চাষ হওয়ায় ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মালাধারপুর গ্রামের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন কোটচাঁদপুর-মহেশপুর সড়কের গৌরীনাথপুর গ্রামে রাস্তার পাশে গড়ে তোলেন ড্রাগন ফলের একমাত্র আড়ত। তিনিই গৌরীনাথপুর ড্রাগন ফলের আড়ত তৈরির প্রথম উদ্যোক্তা।
জসিম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধনেপাতা, পেয়ারা, ড্রাগনসহ নানা ফল ও কাঁচামালের ব্যবসা করে আসছেন। গৌরীনাথপুরে একটা ড্রাগন ফলের আড়ত করলে সবার জন্য এই ফল কেনাবেচার সুবিধা হবে, এমন ভাবনা চার বছর ধরেই তার মাথায় ছিল। তবে শুরুর বিষয়টি সহজ ছিল না, যখন আড়ত বানালেন তখন অনেকেই পাগল বলছে, এসব চলবে কি না তা নিয়ে নানাজনের নানা প্রশ্ন ছিল। তবে তিনি আশাবাদী ছিলেন। বর্তমানে তার আড়ত থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হচ্ছে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসেন পাইকাররা।
জসিমের দেখাদেখি নতুন নতুন উদ্যোক্তা-আড়তদার রাস্তার দুপাশ জুড়ে জায়গা কিনে একের পর এক ড্রাগন ফলের আড়ত তৈরি করছেন। অনেকে আবার নতুন নতুন জায়গা কিনেছেন। টিনশেডে একের পর এক নতুন নতুন বিশাল ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে আড়তের সাইনবোর্ড। ব্যবসায়ী বিলাল হোসেন জানান, জসিমের দেখাদেখি একটার পর একটা আড়ত গড়ে উঠছে, যার সংখ্য এখন ছোট-বড় ৫০টি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের উপপরিচালক কৃষিবিদ আজগর আলী জানান, ধানসহ বিভিন্ন ফসল-ফল চাষের চেয়ে ড্রাগন চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় মহেশপুরের গৌরীনাথপুরের ঘরে ঘরে ড্রাগন চাষের কারণে গ্রামটিকে ড্রাগন গ্রাম বলা হয়। গত চার মাস আগের পাইকারি বাজারটি এখন ড্রাগনের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, গ্রামে এমন বাজার দেশের প্রথম বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গৌরীনাথপুর ড্রাগন বাজারে টিনশেড নির্মাণসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এখানকার কৃষকদের ড্রাগন ফল বিদেশে রপ্তানি করতে শতাধিক কৃষক হ্যাপি হাট নামে দুবাইয়ের একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এরই মধ্যে ফলের ওজন এবং বিষমুক্ত কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। তারা প্রতি সপ্তাহে দুই টন করে ড্রাগন ফল পাঠাবেন দুবাইয়ে।
তবে চাষিদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কৃষিবিদ আজগর আলী বলেন, অভিযোগ আসতে শুরু করেছে কিছু অসাধু চাষি, ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হতে ড্রাগন ফলে টনিক নামে এক ধরনের ভারতীয় হরমন ব্যবহার করছেন। এতে ফল দ্রুত বড় ও পেকে যাচ্ছে, তবে তা স্বাদহীন হয়ে পড়ছে। এটি চলতে থাকলে ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকরা।