× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ব্যাংকঋণে দুমুখো নীতি

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৪২ এএম

আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৫৪ এএম

ব্যাংকঋণে দুমুখো নীতি

একদিকে যখন ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ ছাড়, ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফের ছড়াছড়ি; অন্যদিকে তখন চলে দেশের গরিব কৃষকদের মামলা দিয়ে ঋণ আদায়ের কঠিন তোড়জোড়। দেশের ব্যাংক খাতজুড়ে এমন দুমুখো নীতিই চলে আসছে বছরের পর বছর। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকঋণের যত টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে তার বেশিরভাগই পেয়েছেন বড় বড় ঋণগ্রহীতারা। আর অল্প টাকার দায় নিয়ে বহু কৃষকের হাতে পরানো হয়েছে হাতকড়া। এক দেশে দুই রকম নীতি নিয়ে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা তীব্র সমালোচনা করলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত স্বল্প ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করা কৃষকদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৯ হাজার ৩৫৭টি মামলা (সার্টিফিকেট মামলা) করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। যার বিপরীতে তাদের পাওনা ৩৯৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কোনো কৃষক ১ লাখ টাকার কম ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করে সেটাই সার্টিফিকেট মামলা। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক) ব্যাংকের জন্য সার্টিফিকেট মামলায় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ১ লাখ টাকা হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের (সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী) ক্ষেত্রে সেই সীমা ৫ লাখ। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশেষ বিবেচনায় এসব ঋণ মওকুফ করে দেওয়া উচিত।

গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে বলেন, ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ২০২২ সালে ৪ হাজার ৬২১ জন ঋণগ্রহীতার ৮ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। 

এ বিষয়ে একক গ্রাহকের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, চলতি বছরের মার্চে তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানি এননটেক্স গ্রুপকে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ‘ওয়ান টাইম এক্সিট’ নীতির আলোকে এই সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালে নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নাসা তাইপে স্পিনার্স ও নাসা স্পিনার্সের ঋণ কিনে ২৬১ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে জনতা ব্যাংক। এই সুদ মওকুফের কারণে ৪১৭ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ কমে দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি টাকায়। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কৃষিঋণ বিভাগের তথ্য বলছে, শুধু জুলাই মাসেই ৯ হাজার ৩৩৮ জন কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাদের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ ৩৮ কোটি ৩৮ লাখ। কিন্তু ওই মাসে ১ লাখ টাকার নিচে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল হয়নি।

এসব বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করেও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খানের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে পাঠানো এসএমএসেরও উত্তর দেননি তিনি। তবে সোনালী ব্যাংকের লোন রিকভারি শাখা থেকে জানানো হয়, সার্টিফিকেট মামলার সবই কৃষকদের বিরুদ্ধে নয়। কিছু আছেন ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা। তারা সরাসরি ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আশরাফ বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের সার্টিফিকেট মামলাগুলো অনেক পুরোনো। দীর্ঘদিন ধরে এসব মামলা ঝুলে আছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকগুলো সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। তা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ব্যাংকগুলো নিজেরাও পুনঃতফসিল করেছে। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এরপরও গত বছরের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল করা ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হতো ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এদিকে গত বছরের শেষে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফলে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফসিল করা ঋণই এখন বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন থেকে তা মুছে ফেলা হয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত যা ছিল ৬০ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা।

বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকদের মধ্যে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়, সেই ঋণের আদায় হার অন্যান্য ঋণের তুলনায় অনেক ভালো। গত অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে পুরো ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে কৃষিতে শুধু ঋণ বিতরণ নয়, আদায়ও বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করেছেন কৃষকরা। তার আগের বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে আদায় বেড়েছে ৫ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কৃষিঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

অন্যদিকে শিল্পঋণের ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা। শিল্প খাতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ঋণ বিতরণও কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। গত (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রান্তিকে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া শিল্পঋণ বিতরণ কমার সঙ্গে আদায়ও কমেছে। গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে আদায় কমেছে ৩৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষ মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৩ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসে বেড়েছে ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। 

হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, মার্চ শেষে শিল্পঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি ৫৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা মোটেও ঠিক নয়। যারা কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে সবার আগে। যারা কৃষক, তাদের ঋণের অঙ্ক খুবই ছোট। এসব ঋণ আদায়ের জন্য তাদের নোটিস দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মামলা করে বা ওয়ারেন্ট নিয়ে হয়রানি করার কোনো মানে হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকেই আইন পালন করতে হবে। কিন্তু কারও ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া, আর কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া ঠিক নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় চাইলে সার্টিফিকেট মামলার বিষয়টি সমাধান করতে পারে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা