প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:০০ এএম
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:১৪ এএম
নিয়মিত অভিযান এবং ভারত থেকে আমদানির হুমকি দিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না মজুদদারদের। প্রবা ফাইল ফটো
দীর্ঘদিন ধরে আলুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৬ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এরপর এক সপ্তাহ হতে চললেও সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু। নিয়মিত অভিযান এবং ভারত থেকে আমদানির হুমকি দিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না মজুদদারদের।
এদিকে লাভ কমার শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা হিমাগারে মজুদ করা আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু কৃষকরাই টাকার প্রয়োজনে মজুদ রাখা কিছু আলু বিক্রি করছেন। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর তৎপরতা চালিয়েও আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।
গতকাল বুধবার আলু মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগে রংপুরে ছয় ব্যবসায়ী ও হিমাগার কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। নগরীর আরমান কোল্ড স্টোরেজে অভিযান পরিচালনা ও জেলা প্রশাসক সম্মেলনকক্ষে আলোচনা সভা থেকে তাদের আটক করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের ৬৩টি হিমাগারে খাবার আলু সংরক্ষিত রয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৫৫ টন। বীজ আলু রয়েছে ৭৭ হাজার ১৫ টন। এ বছর ফলন হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ টন। ইতোমধ্যে সাড়ে ৮ লাখ টন আলু খাবারের জন্য বিক্রয় হয়েছে। অবশিষ্ট মাত্র ২ লাখ মেট্রিক টন আলু দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ভোক্তা পর্যায়ে আলুর চাহিদা মেটানো অসম্ভব। ফলে বড় ধরনের একটি সংকট তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জেলার হিমাগার মালিক, ব্যবসায়ী, কৃষকসহ আলুভিত্তিক চাষের ওপর নির্ভরশীল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া সরকারনির্ধারিত দামে খুচরা পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে না। বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে আগের ৪৫ টাকা দরেই। তবে হিমাগারগুলো থেকে ৩০ টাকা দরেই আলু বের হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। হিমাগার মালিকদের দাবি, হিমাগার থেকে ২৭-৩০ টাকায় আলু বের হলেও খুচরা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরাই অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। সংকটটা সেখানেই তৈরি হচ্ছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা হিমাগার মালিক ও পাইকার আড়তদারদের দোষ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু দিচ্ছেন না।
মুন্সীগঞ্জের কদমরসুল হিমাগারের ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল দুলাল জানান, এ বছর বৈরী আবহাওয়াসহ (সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায়) নানা কারণে গতবারের তুলনায় ৩০ ভাগ আলুর ফলন কম হয়েছে। আবাদ হয়েছেও কম। ফলন কম হওয়াতে এবার বাসাবাড়িতে সংরক্ষিত আলু দ্রুত শেষ হওয়ার কারণে হিমাগার অন্যান্য বছরের তুলনায় আলু দুই মাস আগেই খুলে দিতে হয়েছে। সাধারণত আলু মৌসুমে হিমাগার আগস্টে খুলে দেওয়া হয়। এবার আলুর সংকট থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে খুলে দিতে হয়েছে। এসব কিছুই এবার আলুর বাজারে প্রভাব পড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক হাবিবা নাসরিন বলেন, জেলার হিমাগারগুলোতে ২ লাখ ৬ হাজার টন খাবার আলু সংরক্ষিত রয়েছে। ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানিয়েছেন- বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করলে তাদের লোকসান হবে। এজন্য তারা জেলা প্রশাসকের কাছে দাম আরও বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। পরে জেলা প্রশাসক সবকিছু বিবেচনা করে মৌখিকভাবে হিমাগারে পাইকারি পর্যায়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
বগুড়ায় আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছেন মজুদকারীরা
বগুড়ায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে ১৫ টাকা বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া লাভ কমে যাবে এমন আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা হিমাগারে মজুদ করা আলু বিক্রিও বন্ধ করেছেন। জানা গেছে, কৃষকরাই টাকার প্রয়োজনে হিমাগারে মজুদ রাখা স্বল্প পরিমাণ আলু বিক্রি করছেন।
সরকারি দামে আলু কেনাবেচা নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে বগুড়ার শিবগঞ্জের একটি হিমাগারে অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে তথ্য কারসাজির মাধ্যমে আলুর বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে স্থানীয় আর অ্যান্ড আর পটেটো কোল্ড স্টোরেজে তৎপর তিন দালালকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ সময় তিনি ভারত থেকে আলু আমদানির হুমকি দেন। কিন্তু গতকাল বগুড়ার পাইকারি এবং খুচরা কোনো বাজারেই আলুর দাম তেমন কমেনি। ভালো জাতের আলু আগের মতোই প্রতি কেজি ৫০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে হিমাগারগুলোতে মজুদ আলুর বিক্রিও কমে গেছে।
গতকাল দুপুরে বগুড়া শহরের সাবগ্রাম এলাকায় নর্দান কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে আলুর ক্রেতা-বিক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মজুদদাররা কেউ আলু বিক্রি করতে রাজি নন। শুধু কৃষকরা তাদের মজুদ করা দুই-এক বস্তা আলু বিক্রি করতে আসছেন। সেখানেই কথা হয় সাবগ্রামের কৃষক আব্দুস সোবহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই হিমাগারে আমার চার বস্তা আলু আছে। আজ সেই আলু বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। তাই খাওয়ার জন্য এক বস্তা আলু নিয়ে যাচ্ছি।’ হিমাগারের মালিক আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, কোনো ব্যবসায়ীই যাতে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু কেনাবেচা করতে না পারে সেজন্য তারা ক্রেতা-বিক্রেতার কাছ থেকে রসিদ সংগ্রহ করে রাখছেন।
চট্টগ্রামে ১ লাখ টাকা জরিমানা
মুন্সীগঞ্জের হিমাগার থেকে ২৭ টাকায় কেনা আলু পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছিলে ৩৯ টাকায়। সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে খুচরা বাজারে পণ্য ছাড়ছিলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারে মেসার্স লাকী স্টোরের মালিক হাবিবুর রহমান। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ থেকে সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম তথ্য দিয়েছিলেন হিমাগার থেকে ২৭ টাকা দরে কেনা আলু চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে পাহাড়তলী বাজারে মেসার্স লাকী স্টোরে ২৭ টাকা হিমাগার রেটের ২৫০ বস্তা আলু পাওয়া যায়। ওই আলু ৩৯ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করা হয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়।
রংপুরে অভিযানে আটক ৬
রংপুরে আলু মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগে ছয় ব্যবসায়ী ও হিমাগার কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেনÑ আরমান কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম লেবু, হোমল্যান্ড কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম, শাহ আমানত কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম, আলু ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত বণিক, হাজীরহাটের আলু ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া ও পাগলাপীর খলেয়া এলাকার আলু ব্যবসায়ী বাহার উদ্দিন। গতকাল নগরীর আরমান কোল্ড স্টোরেজে অভিযান পরিচালনা ও জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আলোচনা সভায় তাদের আটক করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সিন্ডিকেট চক্রের ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরির কথা স্বীকার করেছেন। এসব চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এরপরও দেশ ও ১৭ কোটি মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করা হলে আমরা আলু আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করব।’