জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:১২ পিএম
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:১৫ পিএম
অর্থঋণ আদালতে ক্রমেই বাড়ছে ব্যাংকের মামলার সংখ্যা। আইনের ফাঁক গলিয়ে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা বেরিয়ে গেলেও সাজা ভোগ করছেন সাধারণ গ্রাহক। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিবছরই অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়। কিন্তু আদায়ের হার একেবারেই নগণ্য। এতে প্রকৃত ক্ষতি হয় ব্যাংকেরই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪০টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগে ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে বিচারাধীন মামলা বেড়েছে ৩৭১টি। এর বিপরীতে নতুন করে ১১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। তারও ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন শেষে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি মামলার বিপরীতে ঝুলে ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ৪৪ হাজার ৬০৫টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে ৯৫ হাজার ৯৩৭ কোটি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ১১ হাজার ১৬৬টি মামলায় ঝুলছে ৭৫ হাজার ৯৭৩ কোটি, বিদেশি ব্যাংকের ৮ হাজার ৫২২টি মামলায় আটকে আছে ৩ হাজার ৯১৯ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৪ হাজার ৯৩৩টি মামলায় আটকে আছে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৪২৮টি। এর বিপরীতে দেশের বিভিন্ন ঋণখেলাপির কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৭০ হাজার ৪৮৯ কোটি। আলোচ্য সময়ে মোট আদায় হওয়া টাকার পরিমাণ মাত্র ২৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাস আগে ২০২২ সাল শেষে মামলার স্থিতি ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। এর বিপরীতে পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি। সে সময় মোট আদায়ের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে নতুন করে মামলা বেড়েছে ৬ হাজার ৮০টি, দাবিকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২১ হাজার ৩০৫ কোটি এবং তার বিপরীতে আদায় বেড়েছে মাত্র ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকারদের মতে, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় বেসরকারি ব্যাংক। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হার বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যায়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এসব ঋণ এক সময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উল্টো চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ এখন বেসরকারি ব্যাংকেরই মামলা দাবির পরিমাণ বেশি। ব্যাংকাররা আরও জানান, কুঋণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে। আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নেন অনেক ঋণখেলাপি। এর ফলে ব্যাংকের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়। পাশাপাশি নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।
অর্থঋণবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আইন অনুযায়ী আদালতে মামলা করে ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ মামলা দায়ের করা না হলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে অর্থঋণ আদালত আইনে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরে যেসব অর্থঋণ আদালত আছে, সেখানে অর্থঋণ মামলার বাইরেও অন্যান্য মামলা পরিচালনা করে থাকেন অর্থঋণ আদালত। এতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। তা ছাড়া ব্যাংকগুলোকেও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ এ আইনজ্ঞের। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে নিয়মিত মামলার খোঁজ রাখেন সে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, অর্থঋণ আদালতের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু কিছু ব্যাংক মামলা করার পর আর কোনো খোঁজখবর রাখে না। বাদী ও আসামি উপস্থিত না থাকায় বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে মামলা। পরিবর্তন হতেই থাকে শুনানির তারিখ। ২০ বছর ধরে মামলার খবর না রাখার নজির পাওয়া গেছে এ বছর। এমন কাজ করেছে একাধিক বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ঘটনার পেছনে ব্যাংক ও গ্রাহকের জোগসাজশ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।