ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:১৪ এএম
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৫৫ পিএম
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে কমছে খরচ, বাড়ছে ফলন। ছবি : সংগৃহীত
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে চাষাবাদ, ফসল ফলানো ও ধান রোপণ এবং কাটার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। এতে কৃষকের সময়, শ্রম ও অর্থব্যয় কমছে। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে ফসল। তাতে শস্যনিবিড়তা (একই জমিতে বছরে যে কয়েকটি ফসল উৎপাদন করা হয়) বিপুল পরিমাণ ফলন বাড়ছে। শুধু গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষকের ২ হাজার ৭শ কোটিরও বেশি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হলে কৃষিতে আরও সাফল্য পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলার আলমপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আজিজ গত বোরো মৌসুমে কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কেটেছেন। এতে তার ৫ বিঘা জমিতে ১২ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটার ক্ষেত্রে শ্রমিক ব্যয় হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি ৭০০ টাকা করে ৪ জনকে ২৮ শত টাকা দিতে হয়। তাদের খাবারের জন্য দিতে হয় অতিরিক্ত দুই কেজি চাল। কাটার পর মাড়াইয়ের জন্য মোট ধানের ২০ ভাগের একভাগ দিয়ে দিতে হয়। এতে মোট ব্যয় হয় ৪ হাজার টাকার ওপরে। আর যন্ত্রের সাহায্যে ধান কাটা হলে সব মিলে ব্যয় হয় ১ হাজার ৫০০ হতে ২ হাজার টাকা। তাতে প্রতি বিঘায় সাশ্রয় হয় ১ হাজার ২০০ টাকা।
ধর্মপাশা উপজেলার নুরপুরের কৃষক আব্দুল্লাহ আল আজাদ ও বদরুল ইসলাম একই ধরনের কথা বলেন। তারা জানান, হাওরে কিছু অঞ্চলে ধানের চারাও রোপণ করা হচ্ছে যন্ত্রে। এতে শ্রমিক ব্যয় কমছে।
দেশে চাষাবাদে যন্ত্রের ব্যবহার
১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে গবাদিপশুর ব্যাপক প্রাণহানির কারণে এসব স্থানে চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টর এবং পাওয়ার টিলার বিতরণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রথমবারের মতো ভর্তুকি দিয়ে ৪০ হাজার শক্তি চালিত লো-লিফ্ট পাম্প, ২ হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ এবং ৩ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে “সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প” নামে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন ২০২০ সালের জুলাই হতে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০ কোটি ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
প্রকল্পের লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, কৃষিকে ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা; আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে ফসলের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অপচয় রোধ এবং চাষাবাদে ৫০ শতাংশ সময় ও ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করা; সমন্বিতভাবে সমজাতীয় ফসল আবাদ করে কৃষি যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হলো উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র কৃষকের কাছে পৌঁছানো। এর মাধ্যমে হাওরের ৭ জেলার ৪৪ উপজেলা ও উপকূলীয় ১২ জেলার ৫৯ উপজেলা এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের মাঝে ১২ ক্যাটাগরির এসব আধুনিক কৃষিযন্ত্রপাতি বিতরণ করা। যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে কম্বাইন হারভেস্টার (ধান ও গম এবং ভুট্টা), রিপার ও রিপার বাইন্ডার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার টিলার চালিত বেড প্লান্টার ও সিডার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পাওয়ার উইডার, পটেটো ডিগার, ড্রায়ার, কেরোট ওয়াসা ইত্যাদি।
অবশ্য এর আগে ২০১০ সালের জুলাইয়ে দুই বছর মেয়াদি ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন’ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটি শেষ হলেও সেটি নিয়ে ছিল বিস্তর অভিযোগ।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা ঘণ্টায় ১ একর জমির ধান ও গম কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দি করা য়ায় এবং হেলেপড়া ফসলও কাটা যায়। এ যন্ত্রে একর প্রতি খরচ ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। গতানুগতিক পদ্ধতিতে (শ্রমিক দিয়ে) খরচ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ গতানুগতিক পদ্ধতির চেয়ে খরচ ৬০-৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় হয়। এমনকি একর প্রতি ৫-৮ শতাংশ ধান বেশি পাওয়া যায়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন মৌসুমে বাংলাদেশে আবাদকৃত জমির পরিমাণ ৫৭ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৮.২ হেক্টর। সেখানে যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪২ হাজার ৮৭০.৫১ হেক্টর, অর্থাৎ ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৮৪৯ হেক্টর। যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটা জমির পরিমাণ ১০ লাখ ৯৯ হাজার ১৬৭.৫ হেক্টর, অর্থাৎ ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
আইএমইডির প্রতিবেদন
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ৩০ জুন সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি নিয়ে একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন করেছে। সেখানে ১ হাজার ৮২৪ জন কৃষকের সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে, প্রাণিশক্তি দিয়ে চাষাবাদের তুলনায় যন্ত্র দিয়ে ব্যয় কম হচ্ছে ৪৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় গড়ে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে ফসলের নিবিড়তা ছিল ১৮৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, সেটি ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০৪ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্থাৎ ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ নিবিড়তা বেড়েছে।
প্রতিবেদনে ২৫৯ জন নারী অর্থাৎ ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ নারীর মতামত নেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, কম্বাইন হারভেস্টারের কারণে নারীরাও কৃষি যান্ত্রিকায়নে অবদান রাখছে। তারা রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে চারা রোপণের জন্য ট্রেতে চারা উৎপাদন করে আয় করছেন।
প্রতিবেদনে কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ কৃষক জানান, ভর্তুকি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে অসুবিধা হয়েছে, ৪৩ দশমিক ২৭ শতাংশের দাবি যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্র পেতে সমস্যা হয়েছে। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ কৃষক।
প্রকল্পটির পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম জানান, প্রকল্পটি তৃতীয় বছর অতিক্রম করছে। ইতোমধ্যে ভর্তুকির মাধ্যমে ৩৩ হাজার ৩৬০টি কৃষিযন্ত্র কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার পরিমাণ ছিল ৪ শতাংশ। এ প্রকল্পের কারণে তিন বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের কারণে কৃষকের ২৭ বিলিয়ন অর্থাৎ দুই হাজার সাতশ চৌদ্দ কোটি ছত্রিশ লাখ ৮০ হাজার তিনশ ৮৭ টাকা বেঁচে গেছে। সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটলে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতো। তা ছাড়া শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯.৮১ ভাগ।