ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:২৪ পিএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:২১ পিএম
বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় চলতি মৌসুমে ভারত ও থাইল্যান্ডে ধানের উৎপাদন কমতে পারে। এরই মধ্যে সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। এতে চালের বৈশ্বিক বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এমন আবহাওয়ায় বাংলাদেশে আমন মৌসুমে ধান উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে আবহাওয়াবিদ ও গবেষকরা ভিন্ন ভিন্ন মতপ্রকাশ করেছেন। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) আভাস দিয়েছে, ধান উৎপাদন কমে আসবে।
ইউএসডিএ গত মার্চ মাসে এক পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ বিপণনবর্ষে তিন মৌসুম মিলিয়ে ৩ কোটি ৭১ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতে পারে। গত ২৩ আগস্টের পূর্বাভাসে তা ৭ লাখ টন কমে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টনে নেমে এসেছে।
বৃষ্টিপাত কমেছে, উৎপাদনও কমতে পারে
আমন ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থা ভারত ও থাইল্যান্ডের পর্যায়ে নামবে কি না, তা জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, গত ৩০ বছরের বৃষ্টিপাতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এবার বর্ষা মৌসুমে ৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। গত তিন বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে ৫০ শতাংশের কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে দেশের অনেক জায়গায় ফসল কম হয়েছে। বিশ্বে এল নিনোর প্রভাব চলমান। এ অবস্থায় বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। আমাদের দেশেও হবে। এল নিনোর প্রভাবে ফসলের উৎপাদন কম হতে পারে।
তিনি বলেন, এ বছর জুন-জুলাই মাসে ৫০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী বছরও একই অবস্থা থাকতে পারে। এ বছরও আমন ফসল কম হতে পারে। তবে এক-দুই বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড দিয়ে বলা যাবে না যে, জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এ বছর জুন-জুলাই মাসে দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় টানা তাপপ্রবাহ গেছে, যা আগে হয়নি বললেই চলে।
মনোয়ার হোসেন বলেন, সারা দেশে সমান বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এবার চট্টগ্রাম ও সিলেটে বৃষ্টিপাতে বন্যা হয়ে গেছে। এই অসম প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে। এই জলবায়ু স্থানীয় এলাকা, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ বিভিন্ন ধরনের এলাকায় ভাগ করা হয়ে থাকে। এসব স্থানের ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবও থাকে। এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে কার্বন গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা। বেশি করে গাছ লাগানো। জলাধার, পাহাড় রক্ষা করা।
সেচের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন রোপণে প্রায় বেশিরভাগ কৃষকই সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে মামনুর রশিদ প্রায় আধা বিঘা জমিতে আমন রোপণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণ আমনের সময় বৃষ্টির পানিতে চাষাবাদ করা হয়। এবার শ্যালো মেশিন থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তা ছাড়া টানি জমিতে (উঁচু জায়গা) সেচ দিতে হচ্ছে। এতে করে প্রথমেই ব্যয় বেড়ে গেছে।’ একই থানার আব্দুল মান্নানও সেচের মাধ্যমে ধান রোপণ করেছেন। আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সাধারণত বৃষ্টির পানিতেই আমন চাষ হয়। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। সময়মতো বৃষ্টি না পেয়ে শ্যালো থেকে সেচ দিতে হয়।’
সেচনির্ভরতায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কৃষি ও আন্তর্জাতিক আবহাওয়া মহাশাখা বিভাগের পরিচালক ড. শামীম হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘ভারতের অবস্থা বাংলাদেশে হবে না। কেননা তারা অতি ভারী বৃষ্টি পেয়েছে এবং তাপপ্রবাহও পেয়েছে। আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের বৃষ্টির পানি এখানকার নদীগুলো দিয়ে যাওয়ার ফলে বেশকিছু জায়গায় ধানের বীজতলা নষ্ট করেছে। এই সমস্যা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। খরার কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, সেচ দিয়ে সেটিও কৃষকরা পুষিয়ে নিতে পারবেন। ফসলের উৎপাদন কমবে না, বরং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। কেননা সেচে তাদের অতিরিক্ত ব্যয় হবে। আমন ফসল তাই আগের মতো খরচবিহীন হচ্ছে না। অবশ্য গত বছর এমন আশঙ্কা প্রকাশ করার পরও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছিল। আমনের সময় আকাশ মেঘলা থাকে, ধান সূর্যের তাপ কম পায়। সেজন্য উৎপাদনও কম হয়। তবে বোরো ফসল পুরোপুরি সেচনির্ভর বলে উৎপাদন ব্যয়ও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘এখন বৃষ্টিপাত না হলেও কৃষক তার ফসল নষ্ট হতে দেবে না। ফসল রক্ষা করতে সেচ দেবে। গত বছরও চাহিদার সময় বৃষ্টি কম হয়েছিল। প্রাক-বর্ষা মৌসুমের প্রভাব পড়ে আউশ চাষে। বর্ষার প্রভাব পড়ে আমন চাষে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগস্টে মাসিক গড় হিসাবে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে পুরো দেশে সেভাবে হয়নি।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানের এই আবহাওয়ায় ভারত বা থাইল্যান্ডের অবস্থানে বাংলাদেশ নেই। আপাতত আমন ফসলের উৎপাদন নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত কম হয়েছিল। সেখানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে এবার বন্যার প্রবণতা নেই। তাই আমনের উৎপাদন নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার পরিস্থিতি নেই। অক্টোবর-নভেম্বরে কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এ বছর হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
উল্লেখ্য, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ। দেশটি বিশ্বে ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ চাল রপ্তানি করে। থাইল্যান্ড ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ভিয়েতনাম ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ মিলে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ চাল রপ্তানি করে থাকে।
প্রভাব ফেলছে জলবায়ুর পরিবর্তন
এদিকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ কান্ট্রি প্রোফাইল, বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ফসল বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলছে। এখানে প্রত্যক্ষ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন। পরোক্ষ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে পানি সম্পদের প্রাপ্যতা এবং ঋতুর ওপর প্রভাব, মাটির জৈব পদার্থের রূপান্তর, মাটির ক্ষয়, কীটপতঙ্গ এবং রোগ-বালাইয়ের আক্রমণাত্মক প্রজাতির আগমন। এমনকি আবাদযোগ্য জমি কমছে। উপকূলীয় অঞ্চলের জমিতে দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা এবং মরুকরণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ফসল আমন ধান, বোরো ধান এবং গমের ফলন সবই ক্ষতির মুখোমুখি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ লবণাক্ততা বেড়ে চালের পরিমাণ ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমতে পারে। প্রতিবেদনে ভুট্টা চাষে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।