× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সরকারি তথ্যে নেই ‘আসল’ বাজার

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৯ এএম

আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৪৭ এএম

সরকারি তথ্যে নেই ‘আসল’ বাজার

বাজারদর নিয়ে কথা বলার শক্তিও যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান এখন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জীবনে। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বেপরোয়া গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্তেরও। বাজার তাদের কাজে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। একমুঠো দীর্ঘশ্বাস।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ফল-মূল কোনো পণ্যেই স্বস্তির খুঁজে পাওয়ার উপায় নেয়। নিরুপায় ক্রেতারা বেশি টাকায় কম পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বাজারের থলে পূর্ণ করার পুঁজি অনেকেরই আর অবশিষ্ট নেই। যদিও ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত বাজারের ওপর যথাযথ মনিটরিংয়ের নিশ্চয়তা। বাজারের হালচাল নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও অবস্থার কোনো হেরফের হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে বাজারের বাস্তব চিত্র আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যগুলোর মধ্যেও ব্যাপক ফারাক লক্ষ করা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দৈনিক বাজারদর নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন তাদের পক্ষ থেকে বাজারদরের তালিকা দিয়ে থাকে। রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর ও উপজেলা পর্যায়ের বাজারদরের উল্লেখ থাকে তাদের তালিকায়। কয়েক দিন ধরে এসব তালিকা লক্ষ করে দেখা গেছে, বাজারে জিনিসপত্রের আসল যে দাম দিতে হয়, তা এসব তালিকায় লেখা দামের ধারেকাছেও নেই। বাস্তব চিত্র আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

টিসিবি রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, কচুক্ষেত, মৌলভীবাজার, মহাখালী, উত্তরা আজমপুর, রহমতগঞ্জ, রামপুরা ও মিরপুর-১ নম্বরের বাজারসহ ১৩টি বাজার পর্যবেক্ষণ করে প্রতিদিন পণ্যের বাজারদরের একটি তালিকা দিয়ে থাকে। টিসিবির ওই তালিকায় মোট ৫৩টি পণ্যের দর দেওয়া হয়। সেখানে একক পণ্য হিসাব করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩৩টি। 

অন্যদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ৯টি তথা মিরপুর ১নং কাঁচাবাজার, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ও নিউমার্কেটের বনলতা বাজার, শ্যামবাজার, রহমতগঞ্জ, মৌলভীবাজার, বাদামতলী ও কদমতলী বাজার থেকে তথ্য নিয়ে বাজারদরের তালিকা করে থাকে। অথচ সেসব বাজার থেকেই তালিকায় উল্লেখ করা দামে জিনিসপত্র কেনা যায় না। কিনতে হয় আরও উচ্চমূল্যে।

টিসিবির ৩১ আগস্টের তালিকায় সরু চালের (নাজির/মিনিকেট) সর্বনিম্ন দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৭২ টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ কারওয়ান বাজারে এ চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৯০ টাকায়। পায়জামের দর দেওয়া হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। বাজারে ৬২ টাকার নিচে পায়জাম চাল নেই বললেই চলে। মোটা চাল ধরা হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এই চালের দামও ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়। বিপণন অধিদপ্তরের তালিকায় সরু চালের দাম দেওয়া হয়েছে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা। মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা কেজি। টিসিবির তালিকায় সরু চালের ক্ষেত্রে গড় হিসাবে কেজিপ্রতি ১৮ টাকা ও বিপণন অধিদপ্তরের তালিকায় ১০ টাকা কম দেখানো হয়েছে প্রকৃত বাজারদর থেকে।

টিসিবির হিসাবে ১ লিটার সয়াবিন তেলের দাম সর্বনিম্ন ১৭০। আর অথচ কারওয়ান বাজারে ১৭৫ টাকার নিচে ১ লিটার তেলের বোতল পাওয়া যায়নি। বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৮১০ থেকে ৮৪০ টাকা। দুটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যের মধ্যেও ১০ থেকে ২০ টাকার পার্থক্য রয়েছে। পাম অয়েলের (লুজ) দর টিসিবি দিয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, বিপণন অধিদপ্তর দিয়েছে ১২৫ থেকে ১২৮ টাকা। এই তেল বাজারে ১২৪ টাকাতে মিলছে। এক্ষেত্রে উল্টো চিত্র। বাজারের দাম লিটারে ৬ টাকা কম।

দেশি পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বিপণন অধিদপ্তরের দাম দেওয়া হয়েছে ৭৫ থেকে ৯০ টাকা, টিসিবির ৮০ থেকে ৯০ টাকা। অথচ পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ১০ থেকে ২৫ টাকা বেশি দাম দিতে হচ্ছে বাজারে। মুগডালের দাম বিপণন অধিদপ্তর দেখিয়েছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা ও টিসিবি ৯৫ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি। কাওরান বাজারে এটি ১১০ টাকার কমে মিলছে না। 

দুটি প্রতিষ্ঠানই ইলিশ মাছের দর ৫০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি লিখেছে। অথচ ইলিশের (৩টিতে কেজি) সর্বনিম্ন দাম হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। অর্থাৎ ইলিশের দামে ৬০০ টাকার ফারাক। বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে করলা বা উচ্ছের দাম ধরা হয়েছে ৫০-৮০ টাকা। অথচ কোনো বাজারেই খুচরায় ৭০ থেকে ১০০ টাকার নিচে করলা বিক্রি হচ্ছে না। বিপণন অধিদপ্তর ব্রয়লার মুরগির কেজি দেখিয়েছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। আর টিসিবি ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা। কিন্তু রাজধানীর বাজারগুলোতে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকায় ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে।

শুকনো মরিচের (দেশি) দাম টিসিবি দেখিয়েছে ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকা অথচ কাওরান বাজারে এ মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। 

বাজার দরের এমন পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে টিসিবির সহকারী পরিচালক (বাজার তথ্য) নাসির উদ্দিন তালুকদার বলেন, আমরা রাজধানীর ১৩টি বাজার পর্যবেক্ষণ করি। তার মধ্যে প্রতিদিন ৬টি বাজারের দরদাম দেখে মূল্যের তালিকা প্রস্তুত করে থাকি। বাজারভেদে দামের কমবেশি হয়। এজন্য এসব তথ্য এমন হয়ে থাকে। 

টিসিবির তথ্য ও বাজারের দাম এক হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যেসব দোকান থেকে তথ্য নিই আপনারা হয়তো সেখান থেকে তথ্য নেন না। সেজন্য তথ্যের ফারাক থাকে। তা ছাড়া টিসিবি সাধারণত বেশি মানুষ খায় এ মানের পণ্যের দাম লিখে থাকে। সব পণ্যেরই একাধিক প্রকার আছে। সে অনুযায়ী দামও বেশি।

নাসির উদ্দিন তালুকদার আরও বলেন, বাজার তথ্যে সমতা আনতে হলে উৎপাদন ব্যয়, সরবরাহের ব্যয় ও মোট চাহিদা কত তা জানা দরকার। এজন্য তথ্যের ডিজিটালাইজ দরকার। সরকার যদি এ কাজ করে তবে দামের এই পার্থক্য কমে আসবে। কেননা আমাদের এসব দাম দেখেই সরকার আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। 

এসব বাজার চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে রেদওয়ান হোসাইন নামের এক ক্রেতা বলেন, মানুষ তো সরকারি ওয়েবসাইট দেখে বাজারে যায় না। তারা যা খুশি লিখে রাখে। এজন্য দরকার বাজার ব্যবস্থার সঠিক মনিটরিং। কেননা এসব তথ্য দেখে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। মানুষও সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আগে আমরা সকালে পত্রিকা দেখে দরদাম করতাম। এখন তো সেই সুযোগও থাকে না। কোনটা রেখে কোনটা বিশ্বাস করব?

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির এক অনুষ্ঠানে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে যে জীবন ধারণ করছে, সেটা কল্পনা করা যাচ্ছে না। মানুষের সঞ্চয় তলানিতে পড়ে গেছে। তারা ধার-কর্জ করছে। সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, মনিটরিং করে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ মাহবুবুর রহমান আলমগীর বলেন, ভিন্ন ভিন্ন দামের কারণে ক্রেতারাও মানসিক চাপে পড়ে। এজন্য প্রয়োজন কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত সেল। এই সেল কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে নেবে আর ক্রেতারাও সঠিক দামে পণ্য পাবে। তা ছাড়া বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় আরও কঠোর হলে দামে পার্থক্য কমে আসবে। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে টিসিবির যুগ্ম পরিচালক ও মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা ৬ থেকে ৮টি বাজার দেখে মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। আমরা যেসব পণ্য ধরে দাম নির্ধারণ করি আপনারা হয়তো সেগুলো ধরেন না। এজন্য দামে এমন পার্থক্য দেখা যায়। তা ছাড়া কয়েকটি বাজার দেখলে এমন পার্থক্য থাকেই। 

তিনি আরও বলেন, বাজারে দিনের একেক সময়ে পণ্যের একেক ধরনের দাম থাকে। আমরা সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বাজারের তথ্য নিয়ে থাকি। কাঁচামালের বাজার ওঠানামা করেই থাকে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা