প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩ ১৩:৫২ পিএম
কোভিডের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এ সংকটের মধ্যেও বাড়ছে অর্থ বহির্গমনের পরিমাণ। বার্ষিক বিবেচনায় বিনিয়োগ বহির্গমন কমলেও বিনিয়োগ স্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারে। ২০২২ সালে নতুন করে বিদেশে ৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা। এর মাধ্যমে ২০২২ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০ কোটি ডলার। কারণ ২০২১ সালে ৩৯ কোটি ডলার ছিল বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি। ওই সময় (২০২১) নতুন বিনিয়োগ হয় ৯ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রধানত দুটি কারণে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি বাড়ে। এক. আগের অধিক বিনিয়োগের সঙ্গে নতুনভাবে হওয়া অল্প বিনিয়োগ যোগ হলে। এ ছাড়া রিইনভেস্টমেন্ট হলে অর্থাৎ ওই দেশে অর্জিত লাভের অংশ পুনরায় বিনিয়োগ হলে। সংকটকালীন এ সময়ে অত্যধিক বিদেশি বিনিয়োগ ঠিক হবে না বলেও মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, দেশের বাইরে বিনিয়োগ হলে লংরানে (দীর্ঘমেয়াদে) এটার রিটার্ন পাওয়া যায়।
এখন পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগের বৈধ অনুমোদন রয়েছে ২৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এর বাইরে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবসা উন্নয়নে বিনিয়োগ নিয়ে থাকে বিদেশে। বেসরকারি ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২১টি প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে ৭ কোটি ৭০ হাজার ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়েছে। অনুমোদন পাওয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০টি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৩৫ ডলার দেশের বাইরে নিয়েছে।
স্টিল খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কেনিয়া ও হংকংয়ে প্রায় ৫২ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে কেনিয়ায় প্রায় ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগ অনুমোদনের বিপরীতে এখন পর্যন্ত নিয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ২০০ ডলার। আর হংকংয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিনিয়োগের অনুমোদন পেলেও এখনও কোনো অর্থ নেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংকার জানান, মূলত চলমান ডলার সংকট এবং টাকার বড় দরপতনের কারণে ধীরে চলার নীতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তা ছাড়া বাংলাদেশের মূলধন হিসাব উন্মুক্ত নয়। যে কারণে কেউ ইচ্ছা করলেই বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারেন না। বিনিয়োগ করতে চাইলে নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করতে হয়। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে সরকারের নির্ধারিত কমিটি অনুমোদন দেয়। যদিও বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি না নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগের চেয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কিংবা কর ফাঁকির অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয় বিভিন্ন উপায়ে এই পুঁজি পাচারকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের একটি অংশের বেশ আগ্রহ ছিল। গত বছর এ বিষয়ে নতুন বিধিমালা প্রণয়নের আগে কিছু কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদনও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে অনুমোদন পাওয়া ১২টির মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানই দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেনি।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু উৎপাদনের জন্যই দেশের বাইরে বিনিয়োগ নেওয়া হয়, তেমন নয়। ওষুধসহ কিছু ক্ষেত্রে পণ্য বাজারজাত করার সুবিধার জন্য বা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে নামমাত্র বিনিয়োগ নিয়ে কোম্পানি খুলতে হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত হলেও তখন সেই দেশে খোলা কোম্পানির নামে পণ্য বাজারজাত করা যায়। অবশ্য শুধু পণ্য বাজারজাত করার জন্য অনেক কোম্পানির বিদেশে শাখা বা লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে। তৈরি পোশাক, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠান পণ্য বিপণনের সুবিধার্থে লোক নিয়োগ দিয়ে বিদেশে এ ধরনের অফিস পরিচালনা করে।
বিদেশে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যে বিনিয়োগটা হয় তার পরিমাণটা খুব কম। তা ছাড়া অবাধ বিনিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। বিদেশে বিনিয়োগের প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। এখন বিশ্ব অর্থনীতি একটা খারাপ সিচুয়েশনের মধ্যে আছে। কবে নাগাদ সমস্যার সমাধান হবে তা বলা যাচ্ছে না। অনিশ্চয়তার মেঘ এখনও ঘন। তাই আমার মতে, অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। সংকটকালীন সময়গুলোতে বিনিয়োগকারীরা ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনে রাখার চেষ্টা করে। যাতে ক্ষতি কমিয়ে ন্যূনতম লাভ করা যায়। এখন ব্যবসায়ীরা হয়তো সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন। বিদেশে বিনিয়োগ কমার বিষয়টি আমার কাছে বড় কোনো দুঃসংবাদ বলে মনে হয় না।’
এদিকে, বাংলাদেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই বেড়েছে ২০ ভাগ। গত বছর বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালে এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। এর আগের বছর যা ছিল ২৮৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।