প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩ ১৪:৩৪ পিএম
মূল্যস্ফীতির চাপ, আর্থিক সংকট ও বিনিয়োগে নানা শর্তের কারণে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষেরা সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভাঙানোর দিকে ঝুঁকছেন। তবে ঋণাত্মক ধারা কাটিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মার্চ) যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৭৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৭৮ টাকা। সব মিলিয়ে ১১ মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কোনো ঋণ পায়নি। উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের চাপে মূল ও মুনাফাসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, একক মাস হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার। বিপরীতে ওই মাসে মূল ও মুনাফা বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৫৫১ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ চলতি অর্থবছর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবরকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালোটাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডেটাবেস তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনও তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন বেশিরভাগ গ্রাহক। তবে এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে এখানে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যার কারণে বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বেশি করা হচ্ছে।
উল্লেখ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। এ সময় তিনি সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করেন। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০২২-২৩ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
শুধু সঞ্চয়পত্র নয়, ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত ও বিদেশি উৎস থেকেও ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। অর্থের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল সরকার। অর্থবছরের শুরু থেকেই এ ধারাবাহিকতা লক্ষ করা গেছে। কারণ তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে তেমন একটা ঋণ দিতে পারেনি। বেশিরভাগ ঋণ এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৮৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৭১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা নিয়েছে নতুন টাকা ছাপিয়ে।
অন্যদিকে, নতুন অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সরকার। কারণ বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণ ও অনুদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদেশি উৎস থেকে অর্থ নির্বাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর বিদেশি উৎস থেকে অর্থ নির্বাহের লক্ষ্য ৭ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা বেশি।