জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩ ১৪:৫১ পিএম
বছরের প্রথম তিন মাসে উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে ঋণ পুনঃতফসিল। ফলে ব্যাপক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে, যা আগের তিন মাসের চেয়ে ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা বেশি।
মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরের তুলনায় ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বেশি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, গত বছরের শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ব্যাংকগুলো অনেক ঋণ পুনঃতফসিল করেছিল। কারণ বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো মুনাফা বেশি দেখাতে খেলাপি ঋণ আদায় ও পুনঃতফসিলে জোর দেয়। তাই ওই প্রান্তিকে ১৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমে আসে। আর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর চাপ ছিল না। তাই পুনঃতফসিল বেশি করার প্রয়োজন হয়নি। পুনঃতফসিল বেশি না হওয়ার ফলে এ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালার আলোকে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে পুনঃতফসিল হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর বিপরীতে মাত্র ৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো।
এর আগের তিন মাস অর্থাৎ ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়, যার বিপরীতে সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ পুনঃতফসিল কমেছে ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। একই সময়ে সুদ মওকুফ কমেছে ১ হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছিল ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে অনেক আগে থেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারে ব্যাংকগুলো। তবে শর্ত শিথিল করে গত ১৮ জুলাই নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। নতুন নীতিমালায় ডাউন পেমেন্টের হার কমিয়ে বকেয়ার আড়াই থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আগে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো। আবার আগে কোনো ঋণ একবারে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যেত। এখন ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রথম দুই দফা ৮ বছর করে ১৬ বছর, তৃতীয় দফায় ৭ বছর এবং চতুর্থ দফায় ৬ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে। এভাবে পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সমঝোতার অঙ্ক’ জমা দেওয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় ছাড় দিয়েছে। নানারকম ছাড় দিয়েও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল গত বছরেও।
সব সুবিধা তুলে নিয়ে গত মঙ্গল ও বুধবার নতুন দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আবারও ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১ এপ্রিল থেকে বিদ্যমান নিয়মিত মেয়াদি ঋণের (স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণসহ) বিপরীতে এপ্রিল-জুন সময়ের জন্য যে কিস্তি দিতে হবে, তার ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না।
এ নির্দেশনা অনুযায়ী সুবিধা নেওয়া গ্রাহকদের কিস্তির বাকি অংশ বিদ্যমান ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আদায় করতে হবে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এসব ঋণ যথানিয়মে খেলাপি করা যাবে। যেসব গ্রাহক এ সুবিধা নেবেন, তাদের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনোরূপ দণ্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। আগে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপিমুক্ত হয়েছেন, এমন গ্রাহকরাও ঋণ পরিশোধের এ সুবিধা পাবেন। একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তলবি ঋণের কিস্তি পরিশোধেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে গ্রাহকদের অনেক সময় ছাড় দেয় ব্যাংক। গ্রাহক বিপদে পড়লে অনেক সময় ছাড় দেওয়া হয়। অল্প কিছু টাকা মওকুফ করে পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যায় অনেক সময়। এতে দুপক্ষই উপকৃত হয়। ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা কম হলেও বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে মনে করেন তিনি।
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান এবং এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, সুদ মওকুফ সুবিধা যদি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বা রুগ্ন শিল্প-গ্রাহকদের দেওয়া হয়, তাহলে ঠিক আছে। এতে দুপক্ষেরই লাভ। কিন্তু এটা যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের দেয়া হয়, তাহলে বিষয়টি বিপজ্জনক। অনেক গ্রাহক এই ছাড়টাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। পুনঃতফসিল করার পর ঋণটা পরিশোধ করেনি। সুতরাং তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে না। ফলে মুনাফা হারাচ্ছে ব্যাংক ও শেয়ারহোল্ডাররা। অন্যদিকে খারাপ হচ্ছে ব্যাংকের স্বাস্থ্য।