× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রক্ষকই ভক্ষক উত্তরা ব্যাংকে

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩ ১০:৫৯ এএম

আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩ ১৪:৩৭ পিএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

অস্তিত্বহীন এক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে উত্তরা ব্যাংক। সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলামের ভাই সফিউল ইসলাম। সময়ের ব্যবধানে খেলাপি হয়ে পড়ে ঋণগুলো।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ভাই সফিউল ইসলামের অপর এক প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের যত গাড়ি। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকায় গড়ে উঠেছে পারিবারিক দুর্নীতিচক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলামের ভাই সফিউল ইসলাম ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে বিপণন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই প্রতিষ্ঠানের অন্য পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন শরিফুল ইসলাম, খালেদা ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাজেদুল ইসলাম ও ফারহানা ইসলাম। হঠাৎ করে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সফিউল ইসলাম তার ৬ হাজার শেয়ার খালেদা ইসলামের কাছে হস্তান্তর করেন।

পাশাপাশি পদত্যাগ করেন চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান খালেদা ইসলাম। হস্তান্তরের এক মাস পার না হতেই ওই বছরের ১৫ নভেম্বর উত্তরা ব্যাংকে একটি সিডি হিসাব খোলে কোম্পানিটি। আর ২৬ ডিসেম্বর বিপণন লিমিটেডের নামে ১৫ কোটি টাকার ওভার ড্রাফট (ওডি) ঋণ মঞ্জুর করা হয় (ইসি মেমো ১১৩১)। পরে বিপণন লিমিটেডের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর ওই ঋণের অর্থ একসঙ্গে বিতরণ করে উত্তরা ব্যাংক।

ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান ব্যবসার জন্য সাধারণত ওডি লোন নিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অল্প করে টাকা উত্তোলন করেন। আবার টাকা জামাও দেন। এসব ওডি হিসাবে ঘন ঘন লেনদেনের প্রবণতা খুব বেশি এবং স্বাভাবিক। একসঙ্গে সব টাকা তুলে নেওয়ার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিপণন লিমিটেডের অনুকূলে ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ শর্টটার্ম লোন বাবদ আরও ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে উত্তরা ব্যাংক। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী আগের ওডি ঋণের ওপর আরোপিত সুদের সমপরিমাণ টাকা আদায়ের বাধ্যবাধকতা ছিল। এ ছাড়া এই ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির জোনাল হেডের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পরিচালকদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তারও কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি উত্তরা ব্যাংক।

খেলাপি হয়ে পড়ায় ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বিপণন লিমিটেডের ১৫ কোটি টাকার ওডি ঋণ প্রথমবারের মতো পুনঃতফসিল করা হয়। পরে ২০২১ সালের ৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মাধ্যমে আবার পুনঃতফসিল করে উত্তরা ব্যাংক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ১৭ জুন সমহারে কিস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা এবং পরবর্তীতে প্রতিমাসে ৬৮ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ টাকা কিস্তি নির্ধারণ করা হয়; যা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ধারা ৫৫ (৫) এবং বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৪/২০১২, তারিখ : ২৩/০৯/২০১২-এর নির্দেশনার লঙ্ঘন।

২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল ও শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এতে বিপণন লিমিটেডের কোনো অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রমও। ফলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সফিউল ইসলাম উত্তরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলামের ভাই। এ ছাড়া তিনি নাভানা গ্রুপের চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সফিউল ইসলাম ৬ হাজার শেয়ার তার স্ত্রী খালেদা ইসলামের নামে স্থানান্তর করেন। খালেদা ইসলামও নাভানা গ্রুপের একজন পরিচালক। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নাভানা লিমিটেড থেকে উত্তরা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি কিনেছে উত্তরা ব্যাংক। কিন্তু এটি অনিয়ম। কারণ ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতিমালা অনুযায়ী একজন পরিচালক, তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, তার অংশীদারত্বে পরিচালিত ফার্ম, তিনি পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন এরূপ প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানি, জামিনদাতা হিসেবে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং পরিচালকের স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন এবং পরিচালকের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির অনুকূলে সকল প্রকার ঋণ সুবিধা, গ্যারান্টি এবং অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে পারবেন না। বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের কার্যবিবরণীতে এ-বিষয়ক কোনো এজেন্ডা দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পরিচালকদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি আমাদের দেশের ব্যাংক খাতে একটি ব্যাড প্র্যাকটিস। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই সবাই ব্যাংকের পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে চায় এবং সেই পদে আজীবন থাকতে চায়। বিচ্ছিন্নভাবে যেসব পরিচালকের তথ্য আসছে সেটা প্রকৃত তথ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সব ব্যাংকের তথ্য বের করে প্রকাশ করে দেওয়া। তাহলে আর কেউ আজীবন ব্যাংকের পরিচালক থাকতে চাইবে না। এদের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলো লুট হচ্ছে। ক্ষুণ্ন হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থ।’ এসব দুর্নীতির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছে উত্তরা ব্যাংক। ঋণ আদায় অগ্রগতি না থাকা এবং দীর্ঘদিন যাবত মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় থাকার পরও খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি এসব ঋণ। পরে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের দৃষ্টিগোচর হলে ঋণগুলো ক্ষতিকর মানে (ব্যাড লোন) খেলাপি দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিকে অবহিত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এ ছাড়া উত্তরা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন খরচের বিল সমন্বয়ে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে হাতিয়া বাজার উপ-শাখা উদ্বোধন, অক্টোবার মাসে শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন, ডিসেম্বর মাসে পাবনার আটঘরিয়া উপ-শাখা ও হাতিয়া শাখা উদ্বোধনের বিল সমন্বয়ে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এক্সিকিউটিভ কমিটির অনুমোদন এবং ব্যাংকটির এইচআর পলিসি অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে হোটেলে অবস্থান করার জন্য কর্মকর্তারা হোটেল ভাড়া বাবদ ৬ হাজার টাকা সর্বোচ্চ প্রকৃত খরচপ্রাপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে বিল সমন্বয়ের জন্য অবস্থানকৃত হোটেল ব্যবস্থাপনার মূল বিলকপি দাখিল করতে হবে। কিন্তু জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা প্রত্যয়ন/স্লিপ (কম্পিউটার প্রিন্ট) গ্রহণ করে বিলটি সমন্বয় করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রবিউল হাসান এবং চেয়ারম্যানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ধরেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও এর কোনো জবাব মেলেনি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা