জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩ ২১:০৭ পিএম
ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের অন্যতম সূচক মূলধন। অথচ বছরের পর বছর মূলধনে বড় ধরনের ঘাটতি নিয়ে চলছে কয়েকটি ব্যাংক। তবে ছয় মাসের ব্যবধানে ৯৬৯ কোটি টাকা বেড়েছে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি।
চলতি বছরের মার্চ শেষে ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ১১টি ব্যাংক। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এসব ব্যাংকের সামগ্রিক মূলধন ঘাটতি ছিল ৩২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। তবে যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয় বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় মূলধনের ঘাটতি বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নেতিবাচক সংকেত দেয়। তাই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি আর্থিক দুর্নীতি এবং শ্রেণীবদ্ধ ঋণের উচ্চ অনুপাতকে ঘাটতির জন্য দায়ী করেন।
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো ব্যাংক মূলধনের ঘাটতির সম্মুখীন হয়, তাহলে তার ধাক্কা শোষণ করার ক্ষমতা কমে যায়।
ঘাটতির এই তালিকায় আছে অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, সোনালী, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক, ন্যাশনাল, পদ্মা, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি নিয়ে এই তালিকার শীর্ষে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
চলতি বছরের মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩২৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ৩৮৯ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ৫৭৫ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৩৪৫ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৩১ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৬৯৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৫৯ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ৩৯৩ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৪ হাজার ৯৪ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।
এসব তথ্য বিবেচনায় বিশ্লেষকরা তাৎক্ষণিকভাবে এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এ ধরনের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দেয়। দেশের ব্যাংক খাত দুর্বল অবস্থায় থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করে থাকে। মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়, যা এ খাতের মূলধন ভিত্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এ রকম ৬১ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মার্চে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটিতে পৌঁছায়। ব্যাংক খাতের মোট ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। তিন মাস আগে এই অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে বড় অঙ্কের অর্থ জরুরি তহবিল হিসেবে আলাদা করে রেখেছে, যার প্রভাব পড়েছে মূলধনের ওপর।
মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে ব্যাসেল ৩ নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, তদারকি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ব্যাংক ব্যবস্থার তদারকিতে নিয়োজিত বৈশ্বিক সংস্থা ব্যাসেল কমিটি কিছু নীতিমালা তৈরি করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত এই নীতিমালা ব্যাসেল ৩ নীতিমালা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৪ সালের রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব ব্যাংকের সিএআর অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ১২ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ব্যাংক খাতের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) ছিল ১১ দশমিক ০১ শতাংশ। তবে মার্চে এ হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন ব্যাংকের সিএআর ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
সিএআর একটি ব্যাংকের মূলধন ও সম্পদের পরিমাণ বিচারে আর্থিক সক্ষমতার পরিমাপ করে থাকে। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া, আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও উপযোগিতা প্রমাণে সারা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায় এটি বহুল ব্যবহৃত একটি সূচক।