জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম
খেলাপি ঋণের ভারে নুয়ে পড়েছে দেশের ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমানতকারীর অর্থ ঠিকমতো ফেরত দিতে না পারাসহ নানা কারণে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশার খবর জানাজানি হওয়ার পর পুরো খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় গত তিন মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ কমেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মোট খেলাপি ঋণের সিংহভাগই এই ৯ প্রতিষ্ঠানের দায়। যাদের প্রত্যেকের খেলাপি ঋণের হার বিতরণ করা মোট ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি। দেশের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করেছে ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। যার ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকাই খেলাপি। হিসাব অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণের এই অঙ্ক বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ; যা এ যাৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এক বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা।
তবে তিন মাস আগে ২০২২ সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সেই হিসেবে কিছুটা কমেছে সামষ্টিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ। সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ফলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে দুই খাতেই খেলাপি কিছুটা কমেছে। আর এটি কমাতে বিপুল ঋণ পুনঃতফসিল, অবলোপন ও সুদ মওকুফ করেছিল প্রতিষ্ঠানগুলো।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে কার্যরত ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি। যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের উপরে উঠলেই আশঙ্কাজনক বলে ধরা হয়। আর মোট ঋণের ২৫ শতাংশের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছেÑ এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫টি। তবে ৯টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই খারাপ। এদের খেলাপি ঋণের হার বিতরণকৃত ঋণের ৫০ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি খেলাপি পিপলস লিজিংয়ের। যার খেলাপির হার ৯৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর পরেই আছে বিআইএফসি; এটির খেলাপির হার ৯৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফারইস্ট ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপির হার ৯৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ৯০ দশমিক ৪০ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৮৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৫২ দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপির পরিমাণ ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই ৯ প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এ খাতের ৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো খাতের সমন্বিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, বাস্তবতা হলো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চলে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও জানা গেছে, এর মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আস্থা অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাকিদের অবস্থা কেন নড়বড়ে হলো, তা নিবিড়ভাবে পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
তিনি বলেন, মানুষ সঞ্চয় করে মূলত লাভের আশায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রত্যাশিত লাভ তো দূরের কথা, আমানতকারীদের আসলের ঘরেই টান পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকার অনুমোদিত এসব নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে; একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি অর্থনীতির এক দুষ্ট ক্ষত। এ ঋণের বড় অংশই ইচ্ছাকৃত। চিন্তার বিষয় হলো, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের টাকা আদায়ে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না। তাই অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও জালিয়াতি রোধ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসছে। যে নীতিমালাগুলো দেওয়া হচ্ছ সেগুলো ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। তারা মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় তো পাবই। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।’
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বের করে নেওয়া হয়েছে প্রচুর অর্থ, যা ফেরত আসেনি। আবার গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির কারণে এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।’