× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

‘সিউইড’ চাষে আছে সম্ভাবনা, নেই উদ্যোগ

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩ ১১:৩৯ এএম

আপডেট : ৩০ মে ২০২৩ ১৪:১১ পিএম

সমুদ্রের তলদেশে সিউইড। ছবি : সংগৃহীত

সমুদ্রের তলদেশে সিউইড। ছবি : সংগৃহীত

অপার সম্ভাবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে অণুপুষ্টিগুণসম্পন্ন সামুদ্রিক শৈবাল ‘সি উইড’ চাষের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। রোগ নিরাময়ী পথ্য ও ওষুধশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে উন্নত বিশ্বে সি উইডের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দিন দিন এর চাহিদা বাড়লেও দেশে এর চাষাবাদের যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই। স্বল্পপরিসরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, নানা কারণে তা-ও মুখ থুবড়ে পড়েছে, তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল সমুদ্রসীমা। এই সমুদ্রসীমাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হলে অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাময় খাত হতে পারত এই সি উইড।

সি উইড হলো একধরনের শৈবাল। এর কোনো শিকড়, ডালপালা ও পাতা নেই। গুরুত্বপূর্ণ অণুপুষ্টি বিদ্যমান থাকায় রোগ নিরাময়ী পথ্য ও ওষুধশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে উন্নত বিশ্বে এই সামুদ্রিক উদ্ভিদটির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে মোট ৩২৯ লাখ মেট্রিক টন সি উইড উৎপাদন করা হয়। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। 

সি উইডের বিশাল এই বৈশ্বিক বাজারে সামান্যতম অংশীদারত্বও নেই বাংলাদেশের। বৈশ্বিক বাজারের প্রায় অর্ধেকের বেশি দখল করে নিয়েছে চীন। দেশটি ২০১৮ সালে উৎপাদিত মোট সি উইডের প্রায় ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ উৎপাদন করেছে। এর পরেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটি উৎপাদন করেছে প্রায় ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ।

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক ড. মো. খালেদ কনক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সি উইডের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অণুপুষ্টি বিদ্যমান থাকায় রোগ নিরাময়ী পথ্য এবং ওষুধশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে উন্নত বিশ্বে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বৈশ্বিক এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ চাইলে সি উইড বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সি উইড উৎপাদনে বাংলাদেশে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি তেমন কোনো ধারণাও নেই। এ ছাড়া সি উইড চাষাবাদ এলাকায় এর দেখভালের কর্তৃত্ব নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ্ব। চাষাবাদ কারা তত্ত্বাবধান করবেÑ মৎস্য অধিদপ্তর নাকি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এসব দ্বন্দ্বের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে সি উইড উৎপাদন। এই শৈবালকে ব্যবহার করে ওষুধসহ মূল্যবান পণ্য তৈরিতে অর্থনৈতিক সহযোগিতারও অভাব রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সি উইড সাধারণত উপকূলীয় সামুদ্রিক এলাকার পাথর, বালু, কাদা, খোলস বা অন্যান্য শক্ত অবকাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মূলত এই প্রজাতির তিন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল দেখা যায়Ñ লাল, বাদামি ও সবুজ। পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে তো বটেই, সি উইড ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি, এন্টি ডায়াবেটিক, এন্টি ক্যান্সার, নিউট্রোপ্রটেকটিভ, ইমিউনোমডুলেটিরিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া, স্কিন হেলথ অ্যান্ড বিউটি, এপিডার্মাল রি-জেনারেশন, এন্টি এইজিং, রিডিউস স্কারস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। স্বাদ, রঙ ও গন্ধ বাড়িয়ে খাদ্যকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ‘ফুড অ্যাডেটিভস’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কাঁচা ও রান্না করা সবজি হিসেবেও এটি খাওয়া যাবে। ব্যবহার করা যাবে ডেইরি এবং ফিশারির ফিড হিসেবে। এর বাইরে শস্যক্ষেত ও বাগানে সার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।

অপার সম্ভাবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে এই সুযোগ কাজে লাগতে পারছে না বাংলাদেশ। কৃষক পর্যায়ে দাম কম, যথাযথ বিপণনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে সি উইড চাষ সেভাবে বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। চাষ না বাড়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সি উইডের যথাযথ বাণিজ্যিক প্রজাতি চিহ্নিতকরণ, অপর্যাপ্ত অ্যাকোয়াকালচার-কৌশল ও ‘বীজ’ হিসেবে ব্যবহৃত জাতের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে অপ্রতুল পোস্ট হারভেস্ট প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও সি উইড দিয়ে মূল্যবান পণ্য তৈরির জ্ঞানের অভাব। এসব সংকটের কারণেই অপার সম্ভাবনাময় এই খাতটির অগ্রগতি খুব একটা হয়নি। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল আলম শাহীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ সি ফুড বলতে বোঝে মাছ আর চিংড়ি। অথচ এর বাইরে সি উইডসহ অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ রয়েছে। বিভিন্ন দেশে এগুলোর চাহিদা অনেক। কিন্তু আমরা যেহতেু এগুলো খাই না, তাই এগুলো নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। অথচ চাইলে আমরা সি উইড রপ্তানি করে অনেক লাভবান হতে পারি।’ 

তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে সেভাবে সি উইড চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে না। প্রথমত, মানুষের খাবার হিসেবে এটি এখনও সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অপ্রচলিত হওয়ায় এই খাবারের প্রতি স্থানীয় লোকজনের আগ্রহ কম। অন্যদিকে এই সামুদ্রিক শৈবাল চাষাবাদে অর্থনৈতিক সহযোগিতারও অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে সি উইড দিয়ে ওষুধসহ মূল্যবান পণ্য তৈরিতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার। এসব কারণে সম্প্রসারিত হচ্ছে না এর চাষ।

তবে এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু সি উইড উৎপাদন হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলার ৪টি উপজেলায় সি উইড চাষ হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওই চারটি উপজেলার ৮০ জন কৃষক ৫৩ মেট্রিক টন সি উইড উৎপাদন করেন। একই বছর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্যালকন ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ৩০০ উপকারভোগী আরও ৫৫ মেট্রিক টন সি উইড উৎপাদন করেন। 

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র কক্সবাজারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশে ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সি উইড চাষ শুরু হয়। তখন খুব সামান্য পরিমাণে চাষ হতো। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসায় এখন চাষাবাদ কিছুটা বাড়ছে। তবে কৃষক পর্যায়ে দাম কম হওয়ায় উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ কম।

গবেষকরা জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিনের উপকূলীয় এলাকায় দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৪ মিটারের একটি জাল দিয়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রায় ৬০ থেকে ৭৫ কেজি ভেজা আলভা ইনটেসটিনালিস (Ulva intenstinalis) প্রজাতির সি উইড উৎপাদন করা যায়। শুকানোর পর যা থেকে ২০-২৫ কেজি পাওয়া যায়। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি সর্বনিম্ন বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে। ফলে ১৫ দিনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করা যায়। এভাবে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রতিটি ৪ মিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের জাল ব্যবহার করে এক মৌসুমে (তিন মাস) প্রায় ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রতিটি ২০ মিটার লম্বা রশি থেকে তিন মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ভেজা সি উইড পাওয়া যায়। একইভাবে ৪ মিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটি আনুভূমিক জাল দিয়ে বাঁকখালীতে প্রায় ২৪ কেজি, ইনানীতে প্রায় ১৪ কেজি এবং চৌফলদণ্ডীতে প্রায় ৭ কেজি আলভা ইনটেসটিনালিস প্রজাতির সি উইড উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া ২০ মিটার লম্বা প্রতিটি একক রশি ব্যবহার করে তিন মাসে সেন্টমার্টিনে প্রায় ৩০৫ কেজি, বাঁকখালীতে প্রায় ২৫৩ কেজি, ইনানীতে প্রায় ১৪৬ কেজি এবং চৌফলদণ্ডীতে প্রায় ৬৪ কেজি একই প্রজাতির সি উইড উৎপাদন করা সম্ভব।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা