এম আর মাসফি
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩ ১৩:২৫ পিএম
শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক প্রচারে ১০৩ কোটি টাকা খরচের একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তবে প্রকল্পটির প্রস্তাবনা থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে ৫৩ কোটি টাকা খরচ কমিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ফলে প্রকল্পটির খরচ দাঁড়িয়েছে ৪৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পটিতে ৫৩ কোটি টাকা খরচ কমানোর বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের স্কাইসোয়াম উইংয়ের যুগ্মপ্রধান আশরাফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তারা ১০৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আমাদের কাছে যেগুলো কমানো যায় মনে হয়েছে, সেখানে কমিয়েছি। তবে ফাইনাল সিদ্ধান্ত হবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়। সেখানে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়তেও পারে এবং কমতেও পারে।’
প্রকল্পের প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে ২৬ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দেবে ইউনিসেফ এবং বাকি ২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে খরচ করা হবে।
এদিকে প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্পটি উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও একই ধরনের পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আইএমইডির সমাপ্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ ধরনের কার্যক্রম চলমান রাখার বিষয়ে সুপারিশ করেছে।
প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হিসেবে প্রস্তাবনায় বলা হয়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং নারীদের সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সর্বজনীন অধিকার সমুন্নত রাখা। টেকসই সামাজিক এবং আচরণ পরিবর্তনের জন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীন নির্ধারিত জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সঙ্গে এসডিজির সংশ্লিষ্ট ছয়টি নীতি বিশেষ করে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারী উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করা।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক এবং আচরণগত পরিবর্তন আনার জন্য উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখা, গণমাধ্যম যোগাযোগ কর্মসূচির কৌশল প্রণয়ন করা এবং শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের অধিকার প্রচারের জন্য কর্মীদের জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পর্কে উৎসাহিত করা।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছেÑ নাটক, গানের অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্পট ডকুমেন্টারি, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পল্লীসংগীত, উঠান বৈঠক, ওরিয়েন্টেশন সভা, ফিচার ও আর্টিক্যাল লেখা এবং প্রকাশনা, বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠান, নীতিনির্ধারকদের নিয়ে ইন্টারেক্টিটিভ অনুষ্ঠান আয়োজন, মীনা কার্টুন, বিভিন্ন মিডিয়ার কর্মীদের ইস্যুভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা, পরিকল্পনা ও পর্যালোচনা কর্মশালা, সেমিনার, মনিটরিং এবং মূল্যায়ন।
প্রকল্পটির খরচ বিভাজনে দেখা যায়, ৪৫ হাজার ৫টি অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচারে খরচ ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। ১০টি আউটসোর্সিং সেবা ক্রয়ে খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ৪৪৯টি মনিটরিং ও মূল্যায়নের খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। পাঁচটি যানবাহনের জ্বালানি বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি টাকা। যানবাহন মেরামত বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) কার্যপত্রে পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাবিত প্রকল্পের সব প্রোগ্রামের খরচ বিভাজন দিতে বলেছে। আগের প্রকল্পে যেহেতু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল, তাই এই প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ব্যয় বিভাজনের বিষয়ে জানতে চেয়েছে কমিশন।
এদিকে এই একই ধরনের প্রকল্পের চতুর্থ ধাপের প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সংস্থাটি তাদের মূল্যায়নে বলেছে, এ প্রকল্পের প্রভাব স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা গেছে। একাধিক তথ্যের ব্যবহার জনগণের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের চলমান অভ্যাস হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন পরিবারে সবার নিয়মমাফিক সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অসুস্থ শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া, গর্ভবতীর সেবা কেন্দ্রে যাওয়া, শিশুদের স্কুল পরিত্যাগ না করা উল্লেখযোগ্য। বহু ক্ষেত্রেই ইতিবাচক সামাজিক বিশ্বাস ও প্রথা সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন শিশু বিবাহ প্রতিরোধ করা, শিশুদের শাস্তি না দেওয়া, শিশু শ্রমকে নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি। সর্বোপরি কাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোর একাধিক সরকারি ও সংস্থাগুলোর গৃহীত নতুন নীতিমালাকে চিহ্নিত করা গেছে। যেমন শিশু বিবাহ আইন সংস্কার, স্কুলে বেত পরিহারের সরকারি নির্দেশনা, প্রাক-প্রাথমিক ভুল পদ্ধতির প্রচলন, স্কুল স্যানিটেশন কর্নার সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য।
আগের প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে শিশু বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদনে বিশেষ বিধিনিষেধ প্রধান করে স্কুল শিক্ষকদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পত্র বিতরণ, বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদনে জন্মনিবন্ধন বা অন্য কোনো জন্ম তারিখের সনদের কপি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিশুশ্রম বন্ধকরণে জাতীয় প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ভিজিট করে আইএমইডি দেখতে পেয়েছে, প্রকল্পের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর ৮৪ শতাংশ হাত ধোয়া, ৮১ শতাংশ শিশু বিবাহ, ৭৪ শতাংশ জন্মনিবন্ধন, ৬৮ শতাংশ শুধু বুকের দুধ পান করানো এবং ৬৩ শতাংশ গর্ভকালীন সেবা বিষয়ে তথ্য পেয়েছিলেন এবং এখনও সেগুলো অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করেন।
এ প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। ১৭ কোটি জনসংখ্যার এ দেশের নারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ শিশু। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসের ধারায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হলেও ক্ষুদ্র ভৌগোলিক আয়তনের বিশাল জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক গোড়ামির কারণে এখনও দেশের বিশালসংখ্যক নারী ও শিশু অধিকার, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়াও শিশু বিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুদের স্কুলে শারীরিক শাস্তি, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদির শিকার হয় নারী ও শিশুরাই বেশি। কিন্তু বাস্তবিক জনমিতির ভাষায় নারী এবং শিশুর পশ্চাৎপরতাকে মেনে নিয়ে কখনোই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের পূর্ণতা আনা সম্ভব না। সমাজের এমন পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নয়ন এবং নারী ও শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণসহ তাদের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।