মেহেরপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৭ পিএম
মেহেরপুরে বারি ৩০ ও ৩৩ জাতের গমের আবাদ করে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছেন। গাংনী উপজেলার একটি গমক্ষেত থেকে ছবিটি তোলা হয়েছে। ছবি প্রবা
কৃষিনির্ভর মেহেরপুরে ধানে লোকসান এবং আটার আকাশছোঁয়া দামের কারণে এবার গমের আবাদে ঝুঁকেছিলেন কৃষকরা। তবে তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছিল হুইট ব্লাস্ট ছত্রাক সংক্রমণ। কেননা গত তিন বছর ছত্রাক সংক্রমণের কারণে কৃষকরা গম চাষ করে মুনাফা করতে পারেননি।
তাই ভালো ফলনের সম্ভাবনা থাকলেও এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তারা।
তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে এবার মেহেরপুরে গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, মেহেরপুরে এবার ৩০০ কোটি টাকার গম উৎপাদন হয়েছে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এবার ১২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে এ বছর গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫১ হাজার মেট্রিক টন। যা গত বছরের তুলনায় ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন বেশি।
বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, প্রতি মেট্রিক টন গমের দাম ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসাবে এবার ৩০০ কোটি ৮৫ লাখ টাকার গম উৎপাদন করেছেন জেলার কৃষকরা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শংকর কুমার মজুমদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, বিগত দিনের গমের লোকসান কাটিয়ে এবার লাভবান হয়েছে কৃষকরা। এ বছর জেলায় ৫১ হাজার মেট্রিক টন গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আগামীতে উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের নানান ধরনের পরামর্শ দেওয়াসহ ব্লাস্ট প্রতিরোধেও করণীয় নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছিলেন কৃষি কর্মকর্তারা। আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, গত পাঁচ বছরে হুইট ব্লাস্টের কারণে গমে লোকসান গুনেছেন কৃষকরা। এ ছত্রাক প্রতিরোধী হিসেবে এবার বারি ৩০ ও ৩৩ জাতের গম উৎপাদন করা হয়। এ জাতের গম আবাদ করে টানা কয়েক বছরের লোকসান কাটিয়ে এবার লাভের মুখ দেখলেন কৃষকরা।
মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন মাঠের কৃষকরা জানান, এ বছর মেহেরপুরে প্রচুর পরিমাণে গমের আবাদ হয়েছে। সবাই গম আবাদ করে লাভের মুখও দেখেছেন।
কৃষকরা আরও জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শে বারি ৩০ ও ৩৩ জাতের গম আবাদ করে লাভের স্বপ্ন পূরণ করেছেন চাষিরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বিঘাপ্রতি ১৫-১৬ মণ গম উৎপাদন হয়েছে। প্রতি বিঘা গম উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮-৯ হাজার টাকা। তবে বাজারে গমের ভালো দাম থাকায় স্বস্তিতে আছেন চাষিরা।
মেহেরপুর সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের কৃষক আলফাজ হোসেন বলেন, ‘এ বছর তিন বিঘা জমিতে গমের আবাদ করেছি। ভালো ফলনও হয়েছে। তবে পুরো মৌসুমজুড়ে উৎপাদন নিয়ে আতঙ্কে ছিলাম। বিগত তিন বছর গমে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় গম থেকে মুনাফা করছেন কৃষকরা।’
একই গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম জানান, প্রতি বিঘা গমে খরচ হয় সাত থেকে আট হাজার টাকা। এ বছর গমের ভালো ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘায় ১৫ থেকে ১৬ মণ ফলনও হয়েছে। প্রতি মণ গমের দাম ২ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসাবে এবার প্রতি বিঘাতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার গম উৎপাদন হয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার চাঁদবিল গ্রামের গমচাষি আবিদুল ইসলাম জানান, বিগত তিন বছর ব্লাস্টের কারণে গমের আবাদ করে তিনি লোকসান করেছেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শে এ বছর চার বিঘা জমিতে বারি ৩০ ও ৩৩ জাতের গম আবাদ করেছেন। এবার তিনি প্রতি বিঘায় গড়ে ১৮ মণ করে গম পেয়েছেন।
মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের কৃষক নাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাজারে আটার কেজি ৭০ টাকা। কিনে খাওয়ার মতো কোনো উপায় নাই, তাই বিগত দিনে গমে লোকসান হওয়ার পরও এ বছর এক বিঘা জমিতে গমের আবাদ করেছিলাম। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গমের আবাদে লাভবান হয়েছি।’
এদিকে গম আবাদ বাড়াতে এবং ব্লাস্ট প্রতিরোধের উপায় বের করায় মত দিয়েছেন মেহেরপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কৃষি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এনামুল আজিম বকুল। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ব্লাস্টের কারণে কয়েক বছর ধরেই গমে লোকসান গুনছেন কৃষকরা। এটি মূলত গমের বীজ থেকে তৈরি হয়। এখান থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে এ অঞ্চল থেকে গমের আবাদ একেবারেই হারিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ব্লাস্ট এই অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বড় আতঙ্কের কারণ। গম কেটে ঘরে তোলার আগ মুহূর্তে যদি বৃষ্টি হয় তাহলেই গমে ব্লাস্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই গম কেটে ঘরে না তোলা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকতে হয় কৃষকদের।
তিনি জানান, এ বছর ব্লাস্ট প্রতিরোধী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বারি ৩০ ও ৩৩ জাতের গম। এটি দিয়ে ভালো ফলন পেলে কৃষকদের মন থেকে শঙ্কা দূর হবে। এবার গমের ভালো ফলন হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকদের মনে শঙ্কা থাকলেও এবার গমে ভালো ফলনের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ করছিলেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা। আমাদের প্রচেষ্টা কাজে লেগেছে। এবার গমে লাভবান হয়েছেন চাষিরা।’