× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আদানি চুক্তির পাতায় পাতায় ঠকেছে পিডিবি!

মামুন-অর-রশিদ

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৬ এএম

আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৭ এএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

চলতি মার্চ থেকে আদানি পাওয়ার ভারতের ঝাড়খণ্ড গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ শুরু করবে। এরই মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে, আদানি চুক্তির পাতায় পাতায় ঠকেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

ধারায় ধারায় আদানিকে দিয়েছে বাড়তি সুবিধা। ১৬৭ পৃষ্ঠার চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে কয়লার দাম, হিট রেট, সিস্টেম লস- সবখানে আদানিকে সুবিধা দিয়েছে পিডিবি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করছাড়, কেন্দ্রের জন্য বিনামূল্যে জমি- এমন কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না বাংলাদেশ। দীর্ঘমেয়াদে এই কেন্দ্র বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে।

সম্প্রতি আদানি গ্রুপের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এক দিনের ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসে। আদানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চুক্তি পরিবর্তন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সরকার যে পথে এই সমস্যার সমাধান করতে চায় তা সাময়িক। ভবিষ্যতে এ সমস্যা আবার তৈরি হতে পারে। আদানি চুক্তির সময় ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ সচিব ছিলেন ড. আহমেদ কায়কাউস, পিডিবির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষে অতিরিক্ত সচিব শেখ ফয়েজুল আমীন আদানির সঙ্গে আলোচনাতে আহ্বায়ক ছিলেন।

বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. আহমেদ কায়কাউস। প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ অবসরে রয়েছেন। শেখ ফয়েজুল আমীন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

কীভাবে এ ধরনের একটি একপক্ষীয় চুক্তিতে তারা সম্মত হলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের বিশেষ বিধানে বিনা দরপত্রে আদানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

শেখ ফয়েজুল আমীনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি দেড় বছর আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে এসেছি। আমার কাছে এখন আর কোনো তথ্য নেই। এখন যারা আছেন আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ 

১৬৭ পৃষ্ঠার চুক্তিটি প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে আসার পর দুইজন দক্ষ প্রকৌশলীর কাছে পাঠানো হয় পর্যালোচনার জন্য। তারা চুক্তিতে কোথায় কোথায় বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়েছে তা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে দুই প্রকৌশলী পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চুক্তির সঙ্গে তুলনামূলক চিত্র প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরেছেন।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানিকে বেশি কয়লা দেওয়া হয়েছে

দুই প্রকৌশলী বলছেন, আদানি পায়রার তুলনায় বেশি কয়লা পাচ্ছে। আজকের বাজারদর ১৫০ ডলার (পরিবহন ব্যয়সহ) হিসাবে করলে আদানিকে কয়লা বাবদ এক দিনে বেশি দিতে হবে পায়রার তুলনায় ৩ লাখ ৬ হাজার ৩০০ ডলার। প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ ৩ কোটি ২১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে নরিনকোর তুলনায় দৈনিক আদানিকে বেশি পরিশোধ করতে হবে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বছরে যদি ৪০ দিন বন্ধ থাকে, তাহলে এক বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ২৫ বছরে যদি ২৫ হাজার কোটি টাকাও পরিশোধ করা হয়, তা এই কেন্দ্রের মোট নির্মাণ ব্যয়ের সমান।

চুক্তিতে পিডিবি অঙ্গীকার করেছে, কোনো অবস্থাতেই কেন্দ্রটির প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড়হার ৩৪ ভাগের নিচে নামবে না। যদি সর্বনিম্ন হার ধরেও হিসাব করা হয়, তাহলেও দৈনিক নরিনকোর তুলনায় ৯৬৫ টন কয়লা বেশি দিতে হবে। যার দাম ১ কোটি ৫১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। চুক্তির পুরো সময় অর্থাৎ ২৫ বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। কয়লার দাম কম বা বেশি হলে এই হিসাবের হেরফের ঘটতে পারে।

কয়লার দামে কারসাজি

কয়লার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদানি যে ফর্মুলা ব্যবহার করছে বাংলাদেশ তাতে আপত্তি তুলেছে। আদানি কয়লার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের কয়লাকে বিবেচনায় নিয়েছে। কিন্তু তারা সর্বোচ্চ মানের কয়লা দিচ্ছে না।

৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ না কিনলে জরিমানা দেবে পিডিবি

চুক্তিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গড় প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ৩৪ শতাংশ থাকতে হবে। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে কিনতেই হবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ পিডিবি না কিনলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানি বাবদ সব ব্যয় হিসাব করে পিডিবিকে জরিমানা দিতে হবে। অন্য কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে পিডিবির যে চুক্তি রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে পিডিবি যতটুকু বিদ্যুৎ নেবে, ততটুকুর দাম হিসাব করে পরিশোধ করবে।

চার মাসের বিদ্যুতের চাহিদা একবারে দিতে হবে

প্রতি চার মাসের ডিমান্ড একবারে দিতে হবে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি কী পরিমাণ বিদ্যুৎ নেবে, তার একটি ডিমান্ড ডিসেম্বরেই দিতে হবে। কোনো কারণে পিডিবি বিদ্যুৎ না নিলেও আমদানি করা কয়লার দাম পিডিবি পরিশোধ করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কয়লা তো পচনশীল জিনিস না। এই কয়লা দিয়ে তো ভবিষ্যতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

প্রকৌশলীরা বলছেন, বাংলাদেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীতে বিদ্যুতের কী পরিমাণ চাহিদা থাকবে, তা চার মাস আগেই বলা সম্ভব না। শীতের সময় রাতে চাহিদা ছয় হাজার মেগাওয়াটের নিচে নেমে আসার রেকর্ড আছে। গ্রীষ্মের মধ্যে কোনো কোনো সময় হুট করে বৃষ্টি নামে। তখন চাহিদা একেবারে কমে যায়। ফলে আদানিকে যে চাহিদা চার মাস আগে দেওয়া হবে সেটি সব সময় ঠিক না-ও থাকতে পারে।

ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেশি পেয়েছে আদানি

প্রকৌশলীরা বলছেন, বাংলাদেশের গ্যাসভিত্তিক ও তেলভিত্তিক বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ২০ পয়সা। বাংলাদেশে যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, আদানির ক্যাপাসিটি সবচেয়ে বেশি। 

কয়লার সিস্টেম লস

দেশের অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১ দশমিক ১০ শতাংশ হারে সিস্টেম লস পাবে আদানি। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরে লাখ লাখ টন কয়লা ব্যবহার করে। প্রতি এক লাখ টনে আদানি ১ হাজার ১০০ টন কয়লা সিস্টেম লস হিসেবে পাবে। অর্থাৎ আদানি প্রতি এক লাখ টন কয়লায় ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা সিস্টেম লস হিসেবে পাবে।

বছরে যদি কেন্দ্রটি গড়ে ৫০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে চলে, তাহলেও এই সিস্টেম লসের মারপ্যাঁচে আদানি হাজার কোটি টাকার ওপরে পিডিবির কাছ থেকে তুলে নেবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিটি আদানির আগে হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কেন্দ্রটি সিস্টেম লস বলে কিছু দেখাতে পারবে না।

সিওডির আগেই অর্থ দাবি করতে পারবে আদানি

আদানির চুক্তিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষামূলক চালুর ৬০ দিন অতিবাহিত হলে বাণিজ্যিক উৎপাদন বা কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট (সিওডি) ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু পিডিবির কারণে যদি কেন্দ্রটি ৬০ দিনের মধ্যে সিওডি ঘোষণা না করে, তাহলে কেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে পিডিবি। সিওডি ঘোষণা করতে যদি এর চেয়ে বেশি সময় নেয়, পিডিবি তাহলে পুরো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্রভাড়া পাবে আদানি। 

অন্যদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে আদানি

আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এই হিসাব করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই কেন্দ্র থেকে যে সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে, তার ব্যয় ধরে বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে। কিন্তু অন্য কোথাও বিদ্যুৎ বিক্রি করে আদানি মুনাফা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদ্যুতের দামে ছাড় পাবে এমন কোনো ধারা চুক্তিতে সংযোজিত নেই।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘চুক্তির আইন অনুযায়ী এ ধরনের একপক্ষীয় চুক্তি অবৈধ। সরকার না পারলে আমরা সাধারণ মানুষই এ ধরনের চুক্তি বাতিল করতে পারি। এর আগে আমরা উচ্চ আদালতে রিট করে জনস্বার্থবিরোধী নাইকো মামলা বাতিল করেছি।’

তিনি বলেন, সরকারি যেসব কর্মচারী এই চুক্তি করেছে, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা