× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনিয়মের প্রশ্নে উত্তর নেই উত্তরা ব্যাংকের

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:৩০ এএম

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৩ এএম

উত্তরা ব্যাংক। সংগৃহীত ফটো

উত্তরা ব্যাংক। সংগৃহীত ফটো

উত্তরা ব্যাংকে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন এর দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিরাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পর্ষদ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান মিলেমিশে অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন ব্যাংকটি থেকে। যে কারণে ব্যাংকের লাভ কমছে। ফলে লভ্যাংশ কম পাচ্ছেন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে বিষয়টি ধরা পড়েছে।

পরিদর্শনে দেখা গেছে, মতিঝিল সিটি সেন্টারের পাশে উত্তরা ব্যাংকের নিজস্ব ভবনে পুরোদমে চলছে পরিচালকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু যত টাকায় এই প্রতিষ্ঠান স্পেস ভাড়া পেয়েছে তার চেয়ে চারগুণ বেশি ভাড়া দিচ্ছে একই ভবনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও এসব অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠালেও উত্তর মেলেনি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উত্তরা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও এগারো তলায় এই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান ইফতেখারুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ১৮ হাজার বর্গফুট স্পেস ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেসার্স আফতাব ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যালস লিমিটেড, মেসার্স সি ট্রেড ফার্টিলাইজার লিমিটেড ও মেসার্স মিলনার্স পাম্পস লিমিটেড। প্রতি বর্গফুট ভাড়া প্রথমে নির্ধারণ করা হয় মাত্র ৬৫ টাকা। ভবনের তিনটি ফ্লোর বা তলা এত কম টাকায় ভাড়া দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শেষ পর্যন্ত ভাড়া ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু একই ভবনের ছাদে গ্রামীণফোন লিমিটেড, র‌্যাংকস আইটি লিমিটেড এবং এক্স-নেট লিমিটেডের কাছ থেকে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫৮ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। নিকটবর্তী সিটি সেন্টারে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শাখার জন্য ভাড়া নেওয়া হচ্ছে প্রতি বর্গফুট ১৬৫ টাকা হিসাবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংক নিজস্ব ব্যবহারের জন্য অপ্রয়োজনীয় সম্পত্তি সাত বছরের বেশি সময় নিজেদের অধিকারে রাখতে পারবে না। এক্ষেত্রে যদি মালিকপক্ষের কারও কাছে ভাড়া দিতেই হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই নামমাত্র মূল্যে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাত বছরের চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যানের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে স্পেস ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ৮০ টাকা বর্গফুট হিসাবে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে উত্তরা ব্যাংক পরিচালকের প্রতিষ্ঠানগুলো। ২৮০ টাকা বর্গফুট হিসাবে যার পরিমাণ হতো ৪২ কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এভাবেই পরিচালক হওয়ার সুবাদে সাত বছরে ৩০ কোটি ২৪ লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, পরিচালকের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি ২০১৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভাড়া দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সেখানে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশেষ পরিদর্শনের সার্বিক পর্যালোচনায় বিষয়টি গুরুতর অনিয়ম, অবহেলা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ-পরিপন্থি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত সুবিধা ও রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে। সাকল্যে এমডির মাসিক বেতন বর্তমানে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন, বাসাভাড়া, বাবুর্চি, গার্ড, সার্ভিস চার্জ, পুনর্ভরণ ভাতা, বাসা মেরামত, আসবাবপত্র, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন বিল, উৎসব ভাতা এবং জিপ গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর বাইরেও তিনি গত কয়েক বছরের মধ্যে করোনাকালীন প্রণোদনা এবং বৈশাখী ভাতা গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ তিনি ২৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৩ টাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছেন। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যত টাকা রাজস্ব দেওয়ার কথা তা তিনি পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

গাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে। তার পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য টয়োটা করোলা ১.৬ এল এবং চেয়ারম্যানের জন্য টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো টিএক্সেল ২০১৯ মডেলের গাড়ি কেনা হয়েছে নাভানা লিমিটেড থেকে। নাভানা লিমিটেডের একজন পরিচালক হচ্ছেন শফিউল ইসলাম, যিনি উত্তরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইফতেখারুল ইসলামের ভাই। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী এটি অনিয়ম। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতিমালা অনুযায়ী একজন পরিচালক, তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, তার অংশীদারিত্বে পরিচালিত ফার্ম, তিনি পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন এরূপ প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানি, জামিনদাতা হিসেবে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং পরিচালকের স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন এবং পরিচালকের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির অনুকূলে সকল প্রকার ঋণ সুবিধা, গ্যারান্টি এবং অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের কার্যবিবরণীতে এ-বিষয়ক কোনো এজেন্ডা দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গাড়ির স্পেসিফিকেশনসহ কোটেশন দাখিল করার জন্য কোনো পত্র, চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ এবং ডেলিভারি প্রত্যয়ন দিতে পারেনি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কারও গাড়ি কেনার আগে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রথমে চাহিদাপত্র পাঠাতে হয়। সেই চাহিদার ভিত্তিতে তারা ব্যাংকের কাছে গাড়ির দাম প্রস্তাব করে। সেই দাম পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন হলেই গাড়ি কেনার বৈধতা পায় ব্যাংক। কিন্তু এখানে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি উত্তরা ব্যাংক।

এ বিষয়ে উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে কল রিসিভ করার পর ব্যস্ত আছেন বলে তিনি ফোন রেখে দেন। প্রশ্ন লিখে পাঠালে তা দেখেও (সিন) কোনো উত্তর দেননি। এরপর ই-মেইলে প্রশ্ন লিখে পাঠানো হয়, কিন্তু উত্তর মেলেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নিয়ম ভেঙে পরিচালকদের মাঝে সুবিধা ভাগাভাগির বিষয়টি মোটেও কাম্য নয়। কারণ এ রকম হলে ব্যাংকিং খাতের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। অবৈধভাবে ব্যাংক পরিচালকদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিচালকের প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে বাধ্য করা অথবা ব্যাংকের নিজস্ব ভবনে তুলনামূলক কম টাকায় স্পেস ভাড়া নেওয়াÑ যাই হোক না কেন তা ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে করে সুশাসনের ঘাটতি তৈরি হয়, ঝুঁকিতে পড়ে আমানত।’

তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার করা খুবই জরুরি। তা ছাড়া পরিচালকদের দেওয়া ঋণ কতটুকু নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে তাও তদন্তের দাবি রাখে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যারা ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী। তাই তারা সব জায়গাতেই ব্যবসা খোঁজেন। তবে নিয়মনীতির মধ্যে থেকে তারা ব্যাংক থেকে সুবিধা নিলে তাতে কোনো আপত্তি নেই। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যাংকের মালিকরা নিয়মনীতি পুরোপুরিভাবে মানেন না। তাই যেকোনো ধরনের সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকেরও মঙ্গল দেখা উচিত।’

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে মন্দঋণে পরিণত হয়েছে ১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ারের সবশেষ বিনিময় মূল্য ২৩ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৩০ দশমিক ৫৬ শতাংশ পরিচালকদের হাতে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ৩৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বাকি শেয়ারের মালিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিদেশিরা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা