খাগড়াছড়ি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৪১ এএম
পাহাড়ে তুলা চাষে ব্যস্ত এক চাষি। প্রবা
একটা সময় পাহাড়ের জুম চাষে প্রচুর তুলা চাষ হতো। পাহাড়ের জুমে ‘কার্পাস’ তুলা চাষের কারণে ব্রিটিশ আমলে পার্বত্যাঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘কার্পাস মহল’। কালের পরিক্রমায় কার্পাস তুলার চাষাবাদ কমে যায়। বর্তমানে জুম থেকে তুলা চাষ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের চাহিদা মেটাতে এবং পাহাড়ের চাষিদের ভাগ্য বদলাতে এরই মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড়ের পতিত জমিতে তুলা চাষে আগ্রহ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
মহালছড়ি উপজেলার তুলাচাষি সুচিত্র চাকমা জানান, প্রতিবিঘায় ৪২০০ থেকে ৪৫০০ চারা বপন করতে হয়। বপনের পর জাত ভেদে ১১০-১২০ দিনের মধ্যে তুলার বোল ফাটতে শুরু করে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৫-৪০টি বোল থাকে, প্রতি বোলে ৫ গ্রাম করে তুলা পাওয়া গেলে প্রতি বিঘায় ৭৩৫ থেকে ৭৫০ কেজি তুলা উৎপাদন সম্ভব। ৩-৪ বারে সব তুলা সংগ্রহ করতে ৪০-৫০ দিন সময় লাগে।
খরচ ও আয় ব্যয়ের বিষয়ে দীঘিনালা উপজেলার তুলাচাষি মাহিল হোসেন জানান, মাঝে মাঝে পানি সেচ, সামান্য সার ও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া তুলা চাষে তেমন একটা খরচ নাই। তুলার সঙ্গে শুরুতেই লালশাক ও পরে বরবটি, ভুট্টা চাষ করা যায়। এ ছাড়া আম, মাল্টা, পেয়ারা বাগানেও তুলা চাষ করা যায়। এক হেক্টর জমিতে ৪-৫ মাসে সার বীজসহ মোট ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হলেও ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার ফসল পাওয়া যায়। তুলা চাষে সরকারিভাবে সেচযন্ত্রের সহযোগিতা পেলে আরও অধিক জমিতে তুলা চাষ করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন চাষিরা।
দেশে তুলার চাহিদা ৭০ থেকে ৮০ লাখ বেল, সেখানে উৎপন্ন হয় মাত্র ১ থেকে দেড় লাখ বেল। দেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিবছর বিদেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার। শুধু তাই নয়, এই খাতেই দেশের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার লোক কাজ করছেন। দেশে তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে পাহাড়ে তুলা চাষের মাধ্যমে কৃষকের দিন বদলাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের খাগড়াছড়ি জোনের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. মোজাফফর হোসেন বলেন, তুলা একটি অর্থকরি ফসল। পার্বত্যাঞ্চলের মাটি তুলার সঙ্গে মিশ্র চাষে উপযোগী। পাহাড়ের অনাবাদি ও জুমে মিশ্রচাষে সম্ভাবনার ফসল তুলা। এটি চাষ করে এখানকার চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। বস্ত্রশিল্পে তুলার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আমাদের প্রতিবছর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অধিক চাহিদার প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশি টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিল এবং অন্যান্য ব্যবহারকারী ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকান ও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল এবং পাকিস্তান থেকে তুলা আমদানি করে থাকে। দেশে তুলার ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিদেশ থেকে আমদানি করতে প্রতিবছর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
পার্বত্যাঞ্চল তথা খাগড়াছড়িতে বর্তমানে আমেরিকান আপল্যান কটন ও চায়না হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ শুরু হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে ১২ থেকে ১৪ মণি পর্যন্ত তুলা উৎপাদন হচ্ছে। তবে ব্যাপকভাবে তুলা উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও দুর্গম এলাকার চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং ভালো সেচ সুবিধা পায় না বলে সেই সুফল মিলছে না। কৃষকদের সরকারি-বেসরকারি, এনজিও বা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তুলা চাষ করা যায়। তাহলে এখান থেকে ২ থেকে ৩ লাখ বেল তুলা উৎপাদন করা সম্ভব এবং এখান থেকে দেশের অনেক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
এবার চলতি মৌসুমে ১ হাজার ২০০ টন আমেরিকান আপল্যান তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় ৩৮৪ হেক্টরেরও বেশি জমিতে শুধু আমেরিকান আপল্যান তুলা চাষ করা হয়েছে বলেও জানান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (প্রশাসন) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প পরিচালক ইফতেহার আহম্মেদ বলেন, ‘তুলা উন্নয়ন বোর্ড কৃষক নির্ধারণ করে দেয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি তুলাসহ ৬টি প্রজাতির তুলা চাষ করা হচ্ছে। তুলা চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণের মাধ্যমে মোট ৯৪০টি পল্ট তৈরি করে দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।