× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রকৃত খেলাপি ঋণ হিসাবের দ্বিগুণ

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:১৩ পিএম

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩৩ পিএম

প্রবা ফটো

প্রবা ফটো

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপি ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবের বাইরে থেকে গেছে আরও চারটি খাত। সেগুলো হলো- ঋণ অবলোপন, পুনঃতফসিল, মামলা ও পুনর্গঠন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলার কারণে বিচারাধীন আছে বড় অঙ্কের টাকা। এসব ঋণখেলাপি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে সেগুলো নেই। এ ছাড়া বিশেষ সুবিধায় (দুই শতাংশে পুনঃতফসিল ও করোনাকালীন ছাড়) বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। যেগুলোতে ছাড় বন্ধ করে দিলেই আবার খেলাপি হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে এটাকে (১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি) খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বলা যাবে না। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এখন অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর সবটা মূল খেলাপির অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। কারণ গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার পরই টাকাটা অবলোপনের খাতায় যুক্ত হয়। অর্থাৎ মামলাজটে আটকে থাকা টাকা থেকে অবলোপনের টাকা বাদ দিতে হবে। হিসাব অনুযায়ী, আদালতের কাঠগড়ায় ঘুরপাক খাওয়া টাকা থেকে অবলোপনের ৬০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা বাদ দিলে ৯২ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা অবশিষ্ট থাকে, যার পুরোটাই খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে।

সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মূল খেলাপি ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি, মামলাজটে আটকে থাকা টাকার অংশবিশেষ ৯২ হাজার ৯২৯ কোটি, ঋণ অবলোপন ৬০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ১৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও ২০১৫ সালে ১৫ হাজার কোটি টাকার পুনর্গঠিত ঋণ। সব মিলে উচ্চপর্যায়ের ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়ায়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপির এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ। করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকাও না দিয়ে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, তার মাত্র ১৫ শতাংশ দিলে আর খেলাপি করা হয়নি। চলতি বছরে বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণে জুনে ৫০ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৬০ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ৫০ শতাংশ দিলে খেলাপি হবেন না ঋণগ্রহীতা। সিএমএসএমই ও কৃষি খাতে জুনে ২৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৩০ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ৪০ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি হিসেবে ধরা হবে না। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মাথায় ঋণ পুনঃতফসিলের শর্তও শিথিল করেন। এই শিথিলতার আওতায় এখন একটি বড় ঋণ কয়েক দফায় ২৯ বছর পর্যন্ত পুনঃতফসিল করা যাবে।

করোনার কারণ দেখিয়ে টানা তিন বছর ঢালাও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শুরু থেকেই এ রকম ঢালাও সুবিধার বিরোধিতা করে আসছেন ব্যাংকাররা। কেননা গড়পড়তা সুবিধার ফলে ব্যবসা ভালো চললেও একশ্রেণির গ্রাহক ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধার ফলে ব্যাংকগুলোও বাড়তি চাপ দিতে পারছে না।

খেলাপি ঋণ কম দেখানোর কৌশল যে করোনার পর থেকেই শুরু হয়েছে তেমনটি নয়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১২ বছর মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। তাতে রেকর্ড পরিমাণে ঋণ পুনঃতফসিল হয়। তবে কিছুদিন না যেতেই সেই ঋণ আবার খেলাপি হতে শুরু করে। এর আগে ২০১৮ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। ২০১৪ সালে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল করে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। আগে কিছু সময়ের জন্য সুবিধা দেওয়া হলেও এখনকার মতো ঢালাও সুবিধা কখনও ছিল না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে ১৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন গ্রাহক। বিভিন্ন নীতিছাড়ের কারণে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায় গত কয়েক বছরে। ২০১৯ সালে মোট ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা একটি রেকর্ড। এরপর থেকে তা কমতে থাকলেও শুরু হয়েছে নতুন সমস্যা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে পুনঃতফসিল করা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা, যার ১৮ শতাংশ পুনরায় খেলাপি। ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে, যার ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ আবারও খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

দেশের ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যবসার পরিবেশ দিতে হবে। তবে অনিয়ম, দুর্নীতির দরজা বন্ধ রেখে। একদিকে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। সবখানে সুশাসনের ঘাটতি। তার মতে, ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এর জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি।

কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। গত ২০ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অবলোপন করেছে সব ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু টাকা আদায় হলেও বিপুল অঙ্কের টাকার কোনো খবর নেই। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, প্রকৃত ঋণ খেলাপি আরও অনেক বেশি। যা জনসাধারণের চোখের আড়াল করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া বড় ঋণগ্রহীতা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ঋণ অবলোপনের অর্থ ফেরত দিতে চাইছেন না। সে কারণে অবলোপনের অঙ্ক বাড়লেও আদায়ের অঙ্ক খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপনের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।

মামলা করে খেলাপি ঋণ আদায়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে বড় ঋণ আদায়ে ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে বেশি। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা বাড়লেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুব কম। গত জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, অর্থঋণ আদালতে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। ছয় মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে ৬৮ হাজার ২৭১টি মামলার বিপরীতে ঝুলে ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।

২০১৫ সালে বিশেষ সুবিধায় ১১টি ব্যবসায়ী শিল্প গ্রুপকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে গ্রুপগুলো বিশেষ সুবিধায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করে। কিন্তু এসব গ্রুপ নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। শর্ত ভঙ্গ করায় আবারও তারা খেলাপি হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা