আনিছুর রহমান
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪১ পিএম
আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫৮ পিএম
প্রতিবছরই পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স-বিও হিসাব কমছে। এতে সহজেই বোঝা যায়, পুঁজিবাজারের ওপর সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমশ কমছে। গত এক দশকে নানা সূচকে দেশের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা। ফলে দেশে ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে ১০ কোটি ছাড়িয়েছে।
এ থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, সাধারণ মানুষ এখন ঘরে টাকা না রেখে ব্যাংকে রাখছে। অর্থাৎ দিন দিন বাড়ছে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চার বছরে ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। শুধু তাই নয়, ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস-- এমএফএস হিসাবও। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইল হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ, যা ২০২২ সালের অক্টোবর শেষে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৭৫ লাখের ওপরে।
আর্থিক লেনদেন বা সঞ্চয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়লেও উল্টোপথে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত কমছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। গত সাড়ে ৬ বছরের সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিবছরই পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০১৬ সালের জুন মাস শেষে বিও হিসাব ছিল ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪২টি, যা ২০২২ সালের শেষে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৪টি। অর্থাৎ এ সময়ে বিও হিসাব কমেছে ১২ লাখ ৯২ হাজার ১৪১টি বা ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই সাড়ে ৬ বছর সময়ের মধ্যে শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবছর ছাড়া পরের বছরগুলোতে পুঁজিবাজারে কমেছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা।
২০১৬ সালের জুন মাসের শেষে বিও হিসাব ছিল ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪২টি, যা ২০১৭ সালের জুন শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ২৬ হাজার ৯৩২টিতে। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিও হিসাব কমেছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫১০টি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও ১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৭টি বিও হিসাব কমে যায়। ২০১৮ সালের জুনে বিও হিসাব দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৭টিতে। তবে নিম্নমুখী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসে পরের অর্থবছরে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিও হিসাব কিছুটা বাড়ে। ওই বছর ৪৫ হাজার ৪৬৩টি যুক্ত হয়ে বিও হিসাব দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৯ হাজার ৮৫০টিতে।
কিন্তু এর পরের অর্থবছরে বিনিয়োগকারী কমেছে আরও অধিক হারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিও হিসাব কমেছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৯টি। ফলে অর্থবছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ লাখ ৫৫ হাজার ৫১১টিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিও হিসাব কমেছে, তবে সংখ্যাটা খুবই কম। ওই অর্থবছরে বিও হিসাব ১৯ হাজার ৮০টি কমে দাঁড়ায় ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩১টিতে।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরেই বিনিয়োগকারীর সংখ্যায় বড় ধরনের পতন হয়। গত অর্থবছরে বিও হিসাব ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯টি কমে দাঁড়ায় ২০ লাখ ৫৩ হাজার ৪২২টিতে।
এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল চলতি অর্থবছরেও। সিডিবিএলের হিসাব বলছে, গত ডিসেম্বরের শেষদিনে বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৬১ হাজার ৩০১টিতে। অর্থাৎ গত ৬ মাসে বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ১২১টি।
২০১০ সালের পুঁজিবাজারের উত্থানের সময় বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখের বেশি, যা ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত ছিল ১৪ লাখ। অর্থাৎ বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন বা রোড শো করেও বাড়ানো যায়নি প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী। ২০২২ সালের শেষদিনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ১১৭টি। অর্থাৎ গত সাড়ে ৬ বছরে ৯৩ হাজার ৪২৪টি বা ৫৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ বিও বন্ধ করে দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
তবে সামষ্টিক হিসেবে বিও হিসাব কমলেও বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। ২০১৬ সালের জুনে শেষে বিও সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৭৭০টি। এ সময়ে কোম্পানির বিও হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৫ হাজার ৬১৭টি বা ৫২ দশমিক ১৫ শতাংশ। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৮৭টিতে।
এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমদ বলেন, বাজার ভালো না থাকলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছাড়বেই। আর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলে আবারও পুঁজিবাজারে আসবেন বিনিয়োগকারীরা। এ জন্য বিনিয়োগকারীর সংখ্যা হিসাব না করে ভালো মানের কোম্পানি তালিকাভুক্তির দিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তার মতে, বিদেশে রোড শো করে বিনিয়োগকারী বাড়ানো যাবে না, যদি না বাজারের ভিত্তি শক্ত হয়।
তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-- বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, আইপিওর জন্য সর্বনিম্ন বিনিয়োগ নির্ধারিত করে দেওয়ায় গেল দেড় বছরে বিও অ্যাকাউন্ট কমেছে। এতে আইপিও আবেদনের জন্য আত্মীয়স্বজনের নামে যেসব বিও হিসাব খোলা হয়েছিল, সেগুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। আসল বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি ভালো খবর।
প্রতিবছর ৩০ জুনের মধ্যে বিও অ্যাকাউন্ট নবায়ন করতে হয়। নবায়নের জন্য ৪৫০ টাকা লাগে। যার মধ্যে সিডিবিএল পায় ১০০ টাকা, হিসাব পরিচালনাকারী ব্রোকারেজ হাউস পায় ১০০ টাকা, বিএসইসি পায় ৫০ টাকা এবং সরকারি কোষাগারে যায় ২০০ টাকা। জুনের মধ্যে টাকা না দিলে জুলাই মাসে অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা স্থগিত করে সিডিবিএল।