জয়নাল আবেদিন
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:৫৭ এএম
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:১৩ এএম
প্রতীকী ছবি
ঋণ শোধ না করেও নিয়মিত থাকা এবং বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের পর এখন চলছে সুদ মওকুফের পালা। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে মোট ১৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এজন্য মওকুফ করা হয়েছে চার হাজার ২১৭ কোটি ২৯ লাখ টাকার সুদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘যখন কোনো গ্রাহক বিপদে পড়ে তখন ব্যাংক কিছুটা ছাড় দেয়। ফলে অল্প কিছু টাকা মওকুফ করে পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যায়। এতে দুই পক্ষই উপকৃত হয়।’ ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা কম হলেও বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করেন তিনি।
তবে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, সুদ মওকুফ সুবিধা যদি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বা রুগ্ণ শিল্পের গ্রাহকদের দেওয়া হয়, তাহলে ঠিক আছে। এতে দুই পক্ষই উপকৃত হয়। কিন্তু এটা যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের দেওয়া হয়, তাহলে বিষয়টা বিপজ্জনক। অনেক গ্রাহক এই ছাড়টাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে; পুনঃতফসিল করার পর লোন আর শোধ করেনি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। ফলে মুনাফা হারাচ্ছে ব্যাংক ও শেয়ারহোল্ডাররা। অন্যদিকে খারাপ হচ্ছে ব্যাংকের স্বাস্থ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে মোট ৩৫০ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। এর বিপরীতে পুনঃতফসিল করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৯৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা মাফ করে ৮৮৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে গ্রাহকদের।
বেসরকারি খাতের ব্যাংক দিয়েছে ২১২ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা। এর বিপরীতে চার হাজার ৫২৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলো মাফ করেছে মাত্র চার লাখ টাকা; আর পুনঃতফসিল করেছে ১২৪ কোটি টাকা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ১৭ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ১১৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা মওকুফ করেছে রাষ্ট্রের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। অক্টোবর-ডিসেম্বরের হিসাব এখনও আসেনি।
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা শিথিল করে, যার মধ্যে ছিল ঋণ থেকে দায়মুক্তির এককালীন ব্যবস্থা। এই সুবিধার আওতায় ঋণগ্রহীতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার চেয়ে কম অর্থ এককালীন পরিশোধ করে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারতেন। এই উদ্যোগে পুনঃতফসিল করা ঋণ বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে মোট ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা একটি রেকর্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। এর ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ আবারও খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালে পুনঃতফসিল করা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ শতাংশ। সে বছর ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ১৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে।
ব্যাংকাররা জানান, কঠোরতার চেয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর উপায় হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে একজন উদ্যোক্তার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি।
এর আগে ২০১৯ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমাণের ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এরও আগে ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেওয়া হয়। বারবার এ রকম শিথিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের চেয়ে সুবিধা নেওয়ার পেছনে ছুটছেন বেশি। আর এসব ছাড়ের কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।