আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ০৯:৫০ এএম
এখনও সাধারণ মানুষের গলার কাঁটা হলো মূল্যস্ফীতি। সবশেষ মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এ নীতি অব্যাহত থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যের ওপর।
যদি জুনে মূল্যস্ফীতি না কমে, তাহলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর যদি মূল্যস্ফীতির হার হ্রাস পায়, তবে এই কড়াকড়ি নীতি থেকে কিছুটা সরে আসার চিন্তা করতে পারে তারা।
এছাড়া, মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, শুধু সুদের হার বাড়িয়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাদের মতে, বাজারে সিন্ডিকেট ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির দিকেও জোর দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা হতে পারে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঋণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। লক্ষ্য থাকে, কর্মসংস্থানের জোগান দিয়ে সরকার নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা।
এদিকে নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ। এ লক্ষ্যপূরণে জুলাই মাসে আসছে প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জুনের মধ্যে ৬-৭ শতাংশে নেমে এলে এক ধরনের সিদ্ধান্ত হবে। তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না এলে আগের সিদ্ধান্ত আরও কিছুদিন বজায় রাখা হতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার, রিজার্ভসহ ব্যাংকিং খাতের চ্যানেলগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এরপর আলোচনা করে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি ডিজাইন করা হবে। মূল লক্ষ্য থাকবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা।’
স্থিতিশীল আছে বিনিময় হার
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির লক্ষ্য অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি, জিডিপি ও ঋণ লক্ষ্যমাত্রা এখনও অর্জিত হয়নি। তবে স্থিতিশীল আছে বিনিময় হার। রেমিট্যান্সে ভর করে বাড়ছে রিজার্ভ। এই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে গত এপ্রিল শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কমানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশ। গত এপ্রিলে যা ছিল ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির নতুন এ লক্ষ্যমাত্রার ফলে আগামী জুনে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়, দেশে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। তাই খেলাপি ঋণের এ চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেশ কিছু ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত ও যথাযথভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। এসব নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে না পারলে আগামীতে জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে। আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।’
এখনও অর্জিত হয়নি সবশেষ মুদ্রানীতির লক্ষ্য
গত মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি আরও কিছুটা কমেছে। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয় ৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এর আগের মাসে, অর্থাৎ এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ১৭। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে দাঁড়ায়। যা ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। জানুয়ারিতে তার আগের মাস থেকে মূল্যস্ফীতি কমেছিল। ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক বেশি।
সবশেষ মুদ্রানীতিতে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমিয়ে রিজার্ভ ধরে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই ক্ষেত্রে সফল হয়েছে সংস্থাটি। তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পাশাপাশি রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা গেছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আরও দুই আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার অর্থ যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) ৪০ কোটি ডলার ঋণের অর্থ যুক্ত হয়েছে।
গ্রস রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ বেড়ে ২৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি মেনে হিসাব প্রকাশের পর থেকে যা সর্বোচ্চ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সুদহার কমানো বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভালোÑ এমন নীতি গ্রহণ করা উচিত। ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ দেখেছি। যেমন সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমছে, ট্রেজারি বিলের সুদহারও কমতে পারে। মানি ম্যানেজমেন্টের যে স্কিমগুলো মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে সেসব পলিসি এখন দেখতে পারছি।’
তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ বাড়ছে, ঋণ শোধ হচ্ছে। পাওনা মেটানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে অর্থনীতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। যদিও অস্থিরতা কমেনি। তারপরও আগের থেকে ভালো হচ্ছে। এসব মাথায় রেখে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা উচিত। তবে সরকারের পলিসি দেখে বোঝা যাচ্ছে, কমংসংস্থান বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। সরকারের মেয়াদ খুবই কম। এতে বিনিয়োগ বাড়ারও কথা না। সামনে নির্বাচন। হয়তো এবাবের মুদ্রানীতিতেও এই বিষয়টা গুরুত্ব পাবে।’
২০০৬ সাল থেকে বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও ২০১৯ সাল থেকে তা একবারে নামিয়ে আনা হয়েছিল। অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে আবারও বছরে দুইবার মুদ্রানীতি দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।