× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দুর্বল ব্যাংক এক হলেও থাকছে পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ

আহমেদ ফেরদাউস খান

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১০:৪৭ এএম

দুর্বল ব্যাংক এক হলেও থাকছে পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ

২০২৪ সালেও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জারের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল সরকার। সরকার বদলের পর শুধু ইসলামী শরিয়াহ্‌ভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত হওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে পাঁচটি ব্যাংকের দুটি আবার একীভূত হতে রাজি নয়। বিষয়টি নিয়ে এখন হযবরল অবস্থা। এদিকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলেও পুনরুদ্ধার হওয়া খুবই কঠিন বলে দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলেও পুনরুদ্ধারে অনেক সময় লাগবে। ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। কোনো কোনো ব্যাংকে খেলাপি ৯৮ শতাংশ। এখন এই ব্যাংকগুলোকে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তো একীভূত করেও লাভ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মেই হারিয়ে যাবে। 

একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম চারটি ব্যাংকেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এ ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করে একীভূতকরণের সাড়ে তিন মাসের রোডম্যাপ ঠিক করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে একীভূতকরণের বিষয়টি জানানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে কীভাবে একীভূতকরণ করা হবে, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপ শেষে ব্যাংকগুলোকে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ব্যাংকগুলোর এমডিদের চুক্তি বাতিল হবে। আর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের বাছাই করা সদস্যসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি পর্ষদ গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক দিকনির্দেশনায় ব্যাংকগুলো পরিচালিত হবে।

জানা গেছে, প্রত্যেক আমানতকারীর অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দিলেও অধ্যাদেশের আলোকে আগামী ১৫ অক্টোবরের পর প্রথমে এসব ব্যাংকের শেয়ার শূন্য করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো একীভূত হলে পরিপূর্ণতা পেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এখন শুরু হলে টানা ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে। এই সাড়ে তিন মাসে ব্যাংকগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বিভিন্ন তথ্য যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচটি টিম কাজ করবে। টিমে ব্যাংকগুলো থেকেও যোগ্য লোক দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত জানুয়ারিতে এসব ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের (একিউআর) জন্য দুটি আন্তর্জাতিক অডিটর নিয়োগ দেয়। সেই কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একীভূতকরণের মূল লক্ষ্য আমানতকারীর আস্থা পুনরুদ্ধার এবং আর্থিক খাতে জঞ্জাল দূর করার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানো। দুর্বল ব্যাংক নিষ্পত্তি করা হবে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ অনুযায়ী। অবশ্য জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে কোনো ব্যাংক যদি সরকার থেকে নেওয়া বিশেষ ধারের টাকা ফেরত দিয়ে নিজেরা চলতে পারে তখন ওই ব্যাংক চাইলে একীভূতকরণ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে।

বৈঠকে উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, সমস্যাগ্রস্ত এই ৫টি ব্যাংকের মোট আমানত রয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। যেখানে ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৯২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। একিউআর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যদিও এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, নিজেদের নিরীক্ষায় তাদের খেলাপি ঋণের হার ২৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়, পাঁচটি ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক গঠন করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য। মালিকপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে চরম দুরবস্থায় পড়লেও এসব ব্যাংকের আশার দিক হিসেবে শক্তিশালী নেটওয়ার্কের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সারা দেশে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। যে কারণে কোনো ব্যাংক থেকে কাউকে ছাঁটাইয়ের দরকার হবে না। তবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ পাওয়াদের নতুন করে যোগ্যতা যাচাই করা হবে। আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের জন্য ঋণ আদায় জোরদার এবং সরকার থেকে কয়েক ধাপে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকলে তা অন্য জায়গায় স্থানান্তর এবং কিছু শাখা বন্ধ করা হবে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো একত্রিত হলে সাময়িকভাবে তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দুর্বল ব্যাংকগুলো যেভাবে রয়েছে, তাদের যদি সঠিক চিকিৎসা না নেওয়া হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নিয়মেই ব্যাংকগুলো হারিয়ে যাবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিনিয়োগকারীরা। তাই সরকারের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কাজ এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে একীভূত হওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে সেটির সঙ্গে একমত নয় এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। এ দুটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন তারা। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলার প্রক্রিয়াও চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

ব্যাংক দুটির ভাষ্য হলো, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের তুলনায় তাদের অবস্থা বেশ ভালো। তারল্য পরিস্থিতি, খেলাপি ঋণের হার ও মূলধন কাঠামোর দিক থেকেও এ দুটি ব্যাংক শক্তিশালী। দুটি ব্যাংকেরই বৈদেশিক বাণিজ্যের (আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স) আকার অনেক বড়। 

পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও একই ধরনের তথ্য মিলছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে এ পাঁচ ব্যাংকের মোট বৈদেশিক বাণিজ্য (আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স) ছিল ৯৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে একাই ৫০ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে এক্সিম ব্যাংক। সে হিসাবে পাঁচ ব্যাংকের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৫৩ দশমিক ৩৯ শতাংশই এ ব্যাংকের মাধ্যমে হয়েছে। গত বছর এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার রপ্তানি ও ২৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। যেখানে একই সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল মাত্র ৭ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। আর গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক গত বছর যথাক্রমে মাত্র ১ হাজার ২৩১ কোটি ও ১ হাজার ১০২ কোটি টাকার বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পেরেছে। তবে একই সময়ে এসআইবিএলের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ২১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ শরিয়াহ্‌ভিত্তিক এ পাঁচ ব্যাংকের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই করেছে এক্সিম ও এসআইবিএল। বাকি ১০ শতাংশ ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়েছে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের এ ধারাবাহিকতা চলতি বছরও অব্যাহত আছে। গত মে পর্যন্ত চলতি বছর ১৮ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার বৈদেশিক বাণিজ্য করেছে এক্সিম ব্যাংক। একই সময়ে এসআইবিএলের বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল ৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে মে পর্যন্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ৮০২ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ৬৫৮ কোটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক ১৪৩ কোটি টাকার বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পেরেছে।

গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক করতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংকই সমস্যাগ্রস্ত। ব্যাংকগুলোর যে রোগ হয়েছেÑ তা না সেরে একীভূত করলেই রোগ সারবে না। রোগ অনুযায়ী দাওয়াই দিতে হবে। কাজেই পাঁচ ব্যাংক একীভূত করাই সমস্যার সমাধান নয়। একীভূত করে যদি রোগ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট করা যায় তাহলে এই রোগ সারবে। যা করতেই অনেক সময় লেগে যাবে। ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার সহজ বিষয় নয়। তবে অসম্ভবও নয়।’ 

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো খেলাপির কারণে এই অবস্থায় এসেছে। খেলাপি ঋণগুলো আদায় করতে হবে। এখন তো আবার খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এই পাঁচ ব্যাংকে যে পরিমাণে খেলাপি ঋণ তা আদায় করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অসুস্থ ব্যাংকগুলো এক হচ্ছে। তাই এই ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার হতে বেশ সময় লাগবে।’


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা