কাউসার আহমেদ
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১০:৪৩ এএম
বোরোর ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে চালের কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৭ টাকা। কিছু কিছু চালের বেড়েছে ১০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। শুধু বোরো নয়, বেড়েছে অন্যান্য চালেরও। অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় ভোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। অথচ ভরা মৌসুমে দাম এভাবে বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরা। এবার ধানের উৎপাদন ভালো, তারপরও দাম বাড়ার পেছনে মজুদদারদের অসাধু তৎপরতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারের মজুদনীতি না মেনে অসাধু ব্যবসায়ীদের চাল মজুদ করার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে।
এদিকে চালের দাম বাড়ার পেছনের কারণ হিসেবে বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ‘মিল মালিকরা দাম বাড়িয়েছেন, ফলে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।’ অন্যদিকে মিল মালিকরা বলছেন, ‘বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তারই প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।’
গতকাল সোমবার রাজধানীর খিলক্ষেত, কুড়াতলী, ভাটারা এবং দিনাজপুরের বাহাদুরবাজার ও নওগাঁ জেলার মোকাম শহরের আলুপট্টি এবং পৌর ক্ষুদ্র বাজার ঘুরে চালের দাম বাড়ার এ তথ্য পাওয়া যায়। এসব বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম কেজিপ্রতি ছয় থেকে আট টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা।’
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল খুচরা দোকানগুলোতে ডায়মন্ড, মঞ্জুর, সাগর, রশিদ প্রভৃতি ব্র্যান্ডের প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৮০-৮২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৭৫-৭৬ টাকা। এছাড়া মোজাম্মেল মিনিকেট চালের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৬-৮ টাকা। বর্তমানে এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৮-৯০ টাকায়। দাম বেশি হওয়ায় অনেক বিক্রেতা এখন দোকানে মোজাম্মেল চাল রাখছেন না বলেও জানান। নিম্ন ও নিম্ন মাঝারি আয়ের মানুষের চাহিদায় রয়েছে সাধারণত মোটা ও মাঝারি চাল। এসব চালের কেজি সাধারণত ৫০-৫৫ টাকার আশপাশে থাকলেও সম্প্রতি মোটা চালের দামও বেড়েছে। মোটা হিসেবে পরিচিত স্বর্ণা চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে ৫৭-৫৮ টাকায় উঠেছে। আর ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের মাঝারি চালের দামও ২ টাকা বেড়ে ৬০-৬২ টাকা হয়েছে।
দিনাজপুরের বাহাদুর বাজারে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে নাজিরশাইল কেজিতে ৬৫ থেকে বেড়ে ৭৫ টাকা, বিআর-২৯ ৪৮ থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা, মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬৪, গুটি স্বর্ণা ৪৫ থেকে ৫২, বিআর-২৮ চাল ৫২ থেকে বেড়ে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি কেজি সুগন্ধি কাটারি ভোগ চাল কেজি ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের আড়ত বাহাদুর বাজারে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৩ হাজার ২০০ টাকা। একইভাবে ২ হাজার ৫৫০ টাকার বিআর-২৯ দুই হাজার ৯০০, ২ হাজার ৭০০ টাকার আঠাশ ৩ হাজার ২০০, দুই হাজার ৭০০ টাকার সুমন স্বর্ণা ২ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সদ্য বাজারে ওঠা শম্পা কাটারি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। আর একই জাতের পুরাতন চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। যা দুই সপ্তাহ আগেও ৫০০ টাকা কমে বস্তা বিক্রি হয়েছিল। এটি পাইকারি হিসাব। পাইকারিতে বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪ থেকে ১০ টাকা।
বাহাদুর বাজারের চালের আড়তদার আশরাফ আলী বলেন, ‘মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।’
খুচরা বাজারে দাম বাড়ায় বিক্রিও কমে গেছে বলে জানান তিনি।
পাইকারি চাল বিক্রেতা এরশাদ আলী বলেন, ‘কোরবানির কয়েকদিন পর থেকে প্রতি বস্তায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়িয়েছেন চালকল মালিকরা। তাদের দাবি ধানের দাম বেশি, এজন্য চালের দাম বাড়িয়েছেন। চালকল মালিকরা দাম বাড়ানোর কারণে আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আর বিক্রির সময় কিছুটা তো লাভ রেখেই বিক্রি করতে হয়। ফলে সাধারণ মানুষকেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।’
নওগাঁ জেলার আলুপট্টি ও পৌর ক্ষুদ্র চালবাজারে জিরাশাইল কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭০ টাকায়। এছাড়া শুভলতা ৬০-৬২ টাকা, কাটারি ৭০-৭২, ব্রিআর-২৮ চাল ৬২-৬৪ এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫৫-৫৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও জিরাশাইল ৬৪-৬৬ টাকা, কাটারি ৬৬-৬৮, শুভলতা ৫৭-৫৮, ব্রিআর-২৮ চাল ৫৯-৬০ এবং স্বর্ণা-৫ কেজি ৫৩-৫৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আলুপট্টি বাজারে চাল কিনতে আসা রিকশাচালক আশরাফুল আলম ও গৃহিণী রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ, হঠাৎ এমনভাবে চালের দাম বাড়ায় বেকায়দায় পড়ছি। শুধু চাল তো নয়, আরও অনেক জিনিস লাগে। সব মিলে হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
খোলাবাজারে চালের দাম বাড়লেও মিল মালিকপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, ‘ভরা মৌসুমে ধানের দাম বাড়ার কারণ তাদের বোধগম্য নয়। ধানের দাম অস্বাভাবিক হারে কেন বাড়ছে তা তারা বুঝতে পারছেন না। মিল সচল রাখতে তাদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি চাল উৎপাদনের খরচ, কর্মচারীদের বেতন, ব্যাংকের সুদ সবকিছুরই হিসাব তাদের রাখতে হয়। ফলে মিলগুলোতে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে।’
পৌর ক্ষুদ্র চালবাজার সমিতির সভাপতি মকবুল হোসেন বলেন, ‘বড় বড় ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে ধান কিনছেন। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় বড় মিলারদের সাথে পেরে উঠছেন না। এটা পুরো একটা সিন্ডিকেট। বাংলাদেশে যে ধান আছে, তা দিয়ে এক বছর চলে যাবে। সরকারি নজরদারি না থাকায় বড় মিলাররা কৃত্রিম মজুদ করেছেন। তাই চালের দাম বাড়ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত অভিযান দরকার।’
বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে, যার ফলে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে স্বীকার করে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কেনার কারণেই চালের দাম বেড়েছে। তারপরও আমরা দামে নিয়ন্ত্রণ চাই। যেসব মিলে অতিরিক্ত মজুদ আছে, সেখানে অভিযান চালানো উচিত।’
বাজারে স্বস্তি ফেরাতে চাইলে ধান-চালের অবৈধ মজুদদারদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, ‘চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ওএমএস (খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি) কর্মসূচি সচল রাখা হয়েছে। অবৈধ মজুদ খুঁজে বের করতে জেলার বিভিন্ন মিল পরিদর্শন করা হচ্ছে। কোথাও অবৈধ মজুদ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ অটো-মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘একশ্রেণির অসাধু মজুদদার ধান কিনে এখন বেশি দামে বিক্রি করছেন। ফলে ধানের দাম বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে চালের। দাম বাড়লে আমাদের দায়ী করা হয়। আমরা চাই এজন্য অভিযান চালানো হোক। অবৈধ মজুদদারদের আইনের আওতায় আনলেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’