আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫ ১৬:০৯ পিএম
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫ ১৯:৪৮ পিএম
চাহিদার তুলনায় খুবই কম নতুন টাকা ছাপার কারণে বাজারে চরম সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন নোটের সন্ধানে ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছেন গ্রাহক। এমনকি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও নতুন নোট পাননি বলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকের শাখাগুলোতে নতুন নোট যেন ‘সোনার হরিণ’। বাধ্য হয়ে অনেকে খোলাবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে কিনছেন নতুন টাকা। ফুটপাতে ২০ টাকার বান্ডিল সাড়ে চার হাজার টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংক, মতিঝিল ও গুলিস্তান সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অগ্রণী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ব্যাংকে চাকরি করেও নতুন নোট পাচ্ছি না। মানুষ তো মনে করে আমাদের কাছে নতুন নোট পাওয়া যাবে। কিন্তু এবার আমরাই পাচ্ছি না। অনেক অনুরোধ থাকে। কিন্তু কারও অনুরোধ তো রাখতে পারছি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এত কম নোট ছাড়া উচিত হয়নি।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে নতুন টাকার চাহিদা তুঙ্গে। গ্রাহকের ভিড় জমানো শাখাগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিস একটি। একজন গ্রাহক সেখানে গিয়ে নতুন টাকা পাননি। ব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখনও টাকা এসে তাদের হাতে পৌঁছেনি। গত রবিবার যা এসেছিল তা শেষ হয়ে গেছে।
ব্যাংকে টাকা না পেয়ে বাধ্য হয়েই খোলাবাজার থেকে নতুন টাকা কিনেছেন নাজমুল ইসলাম। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, খোলাবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে নতুন নোট কিনেছি। আসলে নতুন টাকায় ঈদ সালামি, কেনাকাটা বা উপহারে নতুন টাকা এক বিশেষ অনুভূতির বিষয়। নতুন টাকা শুধু অর্থ নয়Ñ এটি ঈদের স্মৃতি, সংস্কৃতি ও ভালোবাসার প্রতীক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের খোলাবাজার এবং গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ২০ টাকার প্রতিটি নোট ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ৫০ টাকার নতুন নোট বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ১০০০ টাকার নোট দেখা গেলেও এটির চাহিদা খুবই কম।
সরেজমিনে রাজধানীর মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, খোলা আকাশের নিচে পসরা সাজিয়ে বসেছেন নোট ব্যবসায়ীরা, বিক্রি করছেন নতুন নোট। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন ডিজাইনের এসব নোটের চাহিদা থাকায় দামও আকাশচুম্বী। খোলাবাজারে ২০ টাকার একটি নোট বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, ৫০ টাকার নোট ৮০ টাকায় এবং ১০০০ টাকার নতুন নোট কিনতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৫০-৬০ টাকা।
বান্ডিল হিসেবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ২০ টাকার নোটের। প্রতি বান্ডিলে অতিরিক্ত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৫০ টাকার বান্ডিলে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। নতুন নোটে খোলাবাজার জমজমাট হয়ে উঠলেও ব্যাংকে এসব নোটের দেখা মিলছে না। সাধারণ গ্রাহক তো দূরের কথা, ব্যাংক কর্মকর্তারাও নতুন নোট পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।
রাজধানীর একটি প্রাইভেট ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, নতুন নোট ইস্যু হওয়ার পর হাতেগোনা কিছু ব্যাংকে পাওয়া গেছে। আবার হেড অফিসে এলেও ব্যাংকের শাখাগুলোতে এখনও আসেনি। মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই ব্যাংকে এসেছেন নতুন নোটের আশায়, কিন্তু ব্যাংক থেকে নতুন নোট পেতে রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। ফলে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা।
এমনই একজন গ্রাহক আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাইরে নতুন নোট বিক্রি হচ্ছে, অথচ ব্যাংক বলছে পর্যাপ্ত নোট নেই। বাজারে পর্যাপ্ত নোট না এসে থাকলে খোলাবাজারে এত নতুন নোট এলো কীভাবে? রাজধানীর গুলিস্তানেও খোলাবাজারে দেখা মিলেছে নতুন ব্যাংক নোটের।
ঈদে নতুন ডিজাইনের নোট কিনতে গুলিস্তান এসেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সবকিছুতেই সিন্ডিকেট চলছে। টাকার নোট নিয়ে এমন সিন্ডিকেট শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। ব্যাংকে নতুন নোট না পেয়ে বাধ্য হয়ে খোলাবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। তবে খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা কীভাবে নতুন ডিজাইনের এত নোট পেলেনÑ এমন প্রশ্নে কেউ শুরুতে মুখ খুলতে চাননি।
পরে মতিঝিলের এক নোট ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নতুন নোট ব্যাংক থেকেই আসে। বিশেষ করে মতিঝিল ও গুলিস্তানের সরকারি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। তারাই এই নতুন ডিজাইনের নোট সরবরাহ করেন।
ব্যাংক কর্মকর্তারা কতটা লাভ করেনÑ এমন প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, দুই দিন আগে ২০ টাকার একটি বান্ডিল ৯০০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে কিনেছি। এখন ৫০০-৬০০ টাকা লাভে বিক্রি করছি। ৫০ টাকার বান্ডিলেও একই অবস্থা।
গুলিস্তানের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, সরাসরি কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা নোট বিক্রি করেন না। তারা মধ্যবর্তী একটি চক্রের কাছে নোট বিক্রি করেন। সেই চক্র গুলিস্তান-মতিঝিলে আরও চড়া দামে নতুন নোট বিক্রি করে।
অন্যদিকে ঈদুল আজহার ছুটি শুরুর আগে শেষ কর্মদিবসে রাজধানীতে ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে নগদ টাকা তোলা ও অন্যান্য ব্যাংকিং লেনদেনের চাপ বেড়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা ও এটিএম বুথ ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঈদ সামনে রেখে ব্যাংকের শাখাগুলোয় নগদ টাকা তুলতে গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়মিত কর্মদিবসের তুলনায় আজ (গতকাল) লেনদেন বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আগামী ৭ জুন পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। আগামী ১৪ জুন পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ থাকবে। তবে পোশাককর্মীদের বেতন-বোনাস পরিশোধ ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের সুবিধার্থে আগামী ৫, ১১ ও ১২ জুন শিল্প এলাকায় তফসিলি ব্যাংকের শাখা খোলা থাকবে।
মুসলিম মিয়া নামের সোনালী ব্যাংকের এক গ্রাহক জানান, গরু কেনাসহ নানান খরচ আছে। এজন্য কিছু নগদ টাকার প্রয়োজন, তাই ব্যাংকে এসেছি। এসে দেখছি আমার মতো আরও অনেকেই এসেছেন।
রূপালী ব্যাংকের করপোরেট শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অনেকে নতুন ডিজাইনের নোট সংগ্রহ করতে আসেন, কিন্তু সরবরাহ সীমিত থাকায় তা দিতে পারছি না। অনেকে ঈদে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোরবানির পশু কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই তারা নতুন নোট সংগ্রহ করছেন।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্টের পর নতুন করে কোনো টাকা ছাপা হয়নি। বন্ধ রয়েছে পুরাতন ছাপানো টাকা, সরবরাহ কার্যক্রমও। তাই বাজারে নতুন টাকার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ছেঁড়াফাটা নোটে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী পহেলা জুন থেকে বাজারে নতুন টাকা সরবরাহের কথা। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে চাহিদার তুলনায় নগণ্য পরিমাণ টাকা সরবরাহের কারণে তারা টাকা গ্রাহক পর্যায়ে দিতে পারছে না। ফলে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে গ্রাহকের মনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে মাত্র ২০০ কোটি টাকা ছাপানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোটের চাহিদা থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, রবিবার থেকে প্রাথমিকভাবে সীমিত পরিসরে ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নোট বিতরণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিস। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে বিতরণ শুরু হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, শুরুতে রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে সরবরাহ করা হলেও ঈদের ছুটির পর জেলা শহরগুলোতেও মিলবে এসব নোট। তবে ঈদের আগে ব্যাংকে নতুন নোট না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ গ্রাহকরা। ঈদের সালামি দিতে অনেকেই বাধ্য হয়ে তাই খোলাবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে এসব নোট কিনছেন।