প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ২২:০৭ পিএম
রাজধানীর নিকুঞ্জে শনিবার ডিবিএ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার : দর্শন ও অনুশীলন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সংগৃহীত
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারে কারসাজির শাস্তি দেওয়া হয় না। এটাই হচ্ছে পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা। যারা কারসাজি করেছেন, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন। এখন তাদের কেউ কেউ জেলে আছেন। তবে তারা জেলে গেছেন অন্য ঘটনায়। পুঁজিবাজারের অনিয়মের কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
শনিবার (২৪ মে) রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার : দর্শন ও অনুশীলন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব বলেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন বিএসইসি কমিশনার মো. মোহসিন চৌধুরী, জামায়াত ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য মো. মোবারক হোসাইন, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ, জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক ড. তাজনুভা জাবিন, আইসিএমএবির সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শাস্তি যদি না হয় অন্যায় ও দুর্নীতি রোধ করা যায় না। আমরা দেখেছি ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পুঁজিবাজারে অনিয়ম হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় বাজার থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। তার কোনো বিচার হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণে আমরা ২০১০ সালে আবারও একই ধরনের চিত্র দেখেছি। রাজনৈতিকভাবে সিন্ডিকেট করে পুঁজিবাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। যার মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এই ঘটনারও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আশানুরূপ বিনিয়োগ, সঞ্চয় ও কর্মসংস্থান করতে পারছে না। এ ছাড়া এই বাজার যাদের দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই বিনিয়োগকারী, রেগুলেটর, লিস্টেড কোম্পানি ঠিকমতো চলছে না। পুঁজিবাজারে এই মুহূর্তে যে সমস্যা আছে এটা বৃহত্তর কাঠামোতে যদি আলোচনা না করি, তাহলে হবে না। আপনি যদি আলোচনা ছাড়া ঠিক সিদ্ধান্ত নেন, সেটাও ঠিক হবে না। পুঁজিবাজার দিন আনি দিন খাইয়ের জায়গা না। এটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জায়গা।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন আইপিও বন্ধ। এ ছাড়া এরই মধ্যে সূচকে অনেক পতনের মাধ্যমে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এ সমস্যা টোটকা ওষুধ দিয়ে সমাধান হবে না। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বড় উদ্যোগ নিয়ে সমাধান করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার থেকে চালাক। সুতরাং আপনি যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আরও বেশি চালাক ব্যক্তিকে দায়িত্ব না দেন, তাহলে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়েছেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মূল্যায়ন ছাড়াই তাদের লিস্টিং করা হয়েছে, শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে। অথচ কারসাজিকারীরা আজও শাস্তির বাইরে। টোটকা ওষুধে পুঁজিবাজার ঠিক হবে না। এই বাজারের ধাক্কা পুরো অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। এমনকি ওই সময়ে একটি আইপিওও আসেনি।
পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজার একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্লাটফর্ম। ‘দিন এনে দিন খাও’- এমন মানসিকতা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যায় না। একে সচল করতে হলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। তারপরও যদি কাজ না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, বড় ধরনের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে।’
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে তারা কি নিজের সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে? আমার দৃষ্টিতে পারছে না। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার থেকে চালাক। সুতরাং, আপনি যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আরও বেশি চালাক ব্যক্তিকে দায়িত্ব না দেন, তাহলে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।
অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারে অবস্থা আরও দুর্বল হচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, পুঁজিবাজারে এই মুহূর্তে যে সমস্যা আছে এটা বৃহত্তর কাঠামোতে যদি আলোচনা না করি, তাহলে হবে না। আপনি যদি আলোচনা ছাড়া ঠিক সিদ্ধান্ত নেন, সেটাও ঠিক হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘একটা সময় ক্যাপিটাল মার্কেট ভালো প্রগ্রেস করেছিল। গত ১৫ বছরের কথা বলার দরকার নেই, আপনারা সবাই জানেন। বাংলাদেশকে যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আমি বলব এক নম্বর হলো বিনিয়োগ, দুই নম্বর হলো বিনিয়োগ এবং তিন নম্বরও হলো বিনিয়োগ। এর বাহিরে কিছু নেই। এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের বিনিয়োগে ফোকাস করতে হবে। বিনিয়োগ না হলে কীভাবে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগের অর্থের উৎস হতে হবে ক্যাপিটাল মার্কেট। ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে সরকারের ঋণ। ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ, দুটিই সম্ভব। আমাদের দেশে সরকারের ঋণের জন্য আইএমএফের পিছে ঘুরছি। আমরা ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আইএমএফের পিছে পিছে ঘুরছি। একটা দেশের জন্য ৪ বিলিয়ন ডলার কোনো টাকা না। কিন্তু আমরা ৪ বিলিয়ন ডলারের জন্য আইএফএম, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাছে যাচ্ছি।’
আমীর খসরু বলেন, ‘বিশ্বে বছরে ক্যাপিটাল মার্কেটে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার এলোকেশন হয়। সার্বভৌম তহবিল, ইনস্যুরেন্স, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে এই অর্থ আসে। এর মধ্যে ভিয়েতনামেই ৩০০ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশের সংখ্যাটা আমি না বললেই ভালো। ৩০০ বিলিয়ন না বাংলাদেশে ১০০-২০০ বিলিয়ন ডলার আনতে পারলেই বাংলাদেশের বিনিয়োগের চিত্রটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’