আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫ ১০:১৩ এএম
আপডেট : ১২ জুন ২০২৫ ১৫:৪৪ পিএম
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগ নিয়ে দেশজুড়ে চরম আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে বিএনপি, জামায়াত, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ১২ দলীয় জোটসহ বন্দরের শ্রমিক সংগঠনগুলো। প্রায় সব সংগঠনই এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়াকে দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে অবহিত করে আন্দোলনের কথা বলছে। কখনও কখনও বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে বে-টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়া হোক। কোনোভাবেই এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশিদের দেওয়া যাবে না। এমনকি সদ্য কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝেও একই সুর দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় যেখানে ঐকমত্য কমিশন গঠন করে দফায় দফায় বৈঠক করেও সফলতার মুখ দেখছে না অন্তর্বর্তী সরকার; সেখানে কোন মোহন বাঁশির সুরে এনসিটি ইস্যুতে এক সুরে কথা বলছে সবাই? এই প্রশ্ন এখন বেশ জোরেশোরেই উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে রীতিমতো ‘বোমা’ ফাটিয়েছেন সরকারের নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার এক বৈঠকে নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কথোপকথন পড়ে শোনান। যেই গ্রুপে গত ১৭ বছর এনসিটি পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন এবং স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতা বন্দরে অস্থিরতা সৃষ্টি প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন বলে অভিযোগ উপদেষ্টার।
গত ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ ফজলুর রহমান মুন্সি মিলনায়তনে বন্দরের শ্রমিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। কোনো গণমাধ্যমকর্মী সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন না। সভায় নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কথোপকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ে শোনান।
উপদেষ্টার পড়ে শোনানো কথোপকথনে দেখা যায়, নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি সবাইকে নিয়ে রাতেই জরুরি মিটিং করতে জনৈক নাছিরকে নির্দেশ দেন। জবাবে তরফদার রুহুল আমীন বলেন, সবাইকে বোঝাতে হবে বিদেশি কোম্পানি এলে চাকরি চলে যাবে। তাই বন্দর অচল করে দিতে হবে। যত টাকা লাগে দেব, বন্দর অচল করে দেন।
এরপর এনসিটির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তরফদার রুহুল আমিন কতটা মরিয়া সেটি ইঙ্গিত করে উপদেষ্টা বলেন, ‘সাইফ পাওয়ারটেকের তরফদার রুহুল আমিন আমার সঙ্গে কথা বলতে কম করে হলেও ২০ জনকে ধরেছে। কিন্তু এসব করে লাভ হবে না। এখানে কিছু করতে হলে আমাকে সরাতে হবে। আমাকে সরানোও লাগবে না। আপনারা বললেই আমি চলে যাব।’
ওই সভায় দেওয়া উপদেষ্টার বক্তব্য এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। সভায় উপস্থিত থাকা বন্দরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এনসিটি ইস্যুতে বেশ কয়েক দিন ধরেই একের পর এক আন্দোলন হচ্ছে। প্রায় সব দল মাঠে নেমে গেছে। সবার ভাষাই এক। এসব কীভাবে ও কেন হচ্ছে তা নিয়ে কানাঘুষা চলছিল। এর মধ্যেই উপদেষ্টা রীতিমতো বোমা ফাটালেন। সভার শুরুতে শ্রমিক নেতাদের কেউ কেউ খুব উত্তেজিত থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন সামনে আসার পর তারা অনেকে মিইয়ে যান।
এসব বিষয়ে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের কাউকে আমি চিনিও না। শুধু একজনকে চিনি তার সঙ্গে আমার ছয় মাস আগে কথা হয়েছে। এগুলোকে ফেব্রিকেটেড করে আমাকে একটা বিপদে ফেলার জন্য এমন করলেও করতে পারে।’
এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। ২০০৮ সালের ১১ আগস্টে এনসিটি চালু করতে অপারেটর নিয়োগে দরপত্রের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় হাচিসন পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপিএম টার্মিনালস ও ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার টার্মিনাল সার্ভিসেস (আইসিটিএস)Ñ এই চারটি প্রথম সারির বিদেশি অপারেটরকে তালিকাভুক্তও করা হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করে দেওয়া হয়। কিছুদিন পরেই সাইফ পাওয়ারটেককে দেশের একমাত্র টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে বিস্ময়করভাবে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত দেওয়া হয়েছিলÑ শুধু টার্মিনাল অপারেটররাই যোগ্য বলে বিবেচিত হবে আর দেশি টার্মিনাল অপারেটরই অংশ নিতে পারবে। অর্থাৎ এমনভাবে সব এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে কাজ পায় সাইফ পাওয়ারটেক। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে ১১ বারের মতো সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৭ জুলাই। এভাবেই গত ১৭ বছর ধরে সমঝোতা, দরপত্র ও সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এনসিটির কাজ পেয়েছে সাইফ পাওয়ারটেক। অথচ সাইফ পাওয়ার টেককে টার্মিনাল অপারেটর ঘোষণা করা হয়েছে বন্দরের শর্ত না মেনেই।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি অপারেটরদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি আবার সামনে আসে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি অপারেটরের কাছে দেওয়ার বিরোধিতা করে প্রথম মুখ খোলে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামী। গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এ বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমির সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী। এর দুদিন পর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সংগঠক রাসেল আহমেদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা বন্দরের সামনে একই দাবিতে মানববন্ধন করেন। পরে ধীরে ধীরে বাম গণতান্ত্রিক জোট, এলডিপির নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বন্দর শাখা। সর্বশেষ গত রবিবার চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটির ব্যানারে বন্দরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে যোগ দেন চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, ডক শ্রমিক দল ও বন্দরের কর্মচারীরা।
তরফদারের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের আলোচনায় যে নাজিম উদ্দিনের কথা উঠে এসেছে তিনি বিএনপির শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এম নাজিম উদ্দিন বলে ধারণা করছেন অনেকে। ধারাবাহিক আন্দোলন ঘোষণা করা শ্রমিক দলের মূল নেতাও তিনি। এই বিষয়ে জানতে চাইলে এম নাজিম উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওখানে উপদেষ্টা কোন নাজিম উদ্দিনের কথা বলেছেন সেটা তিনি কিংবা তরফদার রুহুল আমিন ভালো বলতে পারবেন। আমার এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।’ বিদেশি অপারেটর নিয়োগের বিরোধিতা প্রসঙ্গে এম নাজিম উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখানে কোনো ব্যক্তিস্বার্থের বিষয় নেই। যেহেতু বন্দর একটা স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সেহেতু এটি পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষতিকর হতে পারে। এ ছাড়া এনসিটিতে সব আছে, এটা কেন বিদেশিদের দিতে হবে। লালদিয়া টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল এসব দেওয়া যেতে পারে।’ এসবের বাইরেও শ্রমিক নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছেÑ বিদেশি অপারেটর এলে প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কর্ম হারাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘বিদেশি অপারেটররা এলে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে, এতে শ্রমিকের ব্যবহার কমবে। মানে শ্রমিকের কাজ করার সুযোগও কমবে। এজন্যও বিদেশি অপারেটর আসা আমরা সমর্থন করি না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিদেশি অপারেটর এলে কী কী শর্তে তাদের সঙ্গে চুক্তি হবে, সেখানে দেশের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ থাকবেÑ এসব নির্ধারণ করতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা এখনও প্রতিবেদন দেয়নি। তবে শ্রমিকদের চাকরি যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, এটি বাস্তবসম্মত না। বন্দরে যারাই কাজ করবে, তাদেরকে বন্দরের নিবন্ধিত শ্রমিকদের থেকেই নিয়োগ দিতে হবে।