আরমান হেকিম
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ০৮:৩০ এএম
আপডেট : ২১ মে ২০২৫ ০৮:৩২ এএম
দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে এমনিতেই পিছিয়ে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন অধ্যাদেশ ঘিরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলম বিরতি যেন মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গেল পাঁচ দিনের বিরতিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থবছরে ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা।
এই ঘাটতি সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজস্ব ঘাটতির কারণে নতুন করে বড় প্রকল্প নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে, বরং চলমান প্রকল্পেও ব্যয় সংকোচন করতে হতে পারে। অর্থাৎ সার্বিক উন্নয়নে এর প্রভাব পড়বে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের বরাদ্দ সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
তবে এনবিআর বিভাজন নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, সেটি এখন দূর হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, এনবিআর আগের ঘোষণা অনুযায়ী দুই বিভাগে বিভক্ত থাকবে। তবে এটি কার্যকর করতে নতুন একটি গেজেট প্রকাশের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, যা বাজেট পেশের পরই চূড়ান্ত করা হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে এনবিআরের কর ও কাস্টমস ক্যাডারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা বলেন উপদেষ্টা। বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ান হাসান এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেভাবে দুই বিভাগে ভাগ করা হয়েছে, সেভাবেই থাকবে। তবে গেজেট প্রকাশের আগেও কিছু প্রস্তুতির কাজ আছে। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব গেজেটটি প্রকাশ করা হোক। আগামী ২ জুন বাজেট দেওয়ার পর এই কাজ শুরু হবে।’
তিনি জানান, এনবিআরের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এখন বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। কর্মকর্তাদের কিছু দাবি ও প্রস্তাব আছে, যেগুলো যুক্তিসঙ্গত হলে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে সরকার যা ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে, দেশের স্বার্থে তা বহাল থাকবে।
ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আর কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘ফরমালি আর কোনো আলোচনা হবে না। তাদের একটি উপদেষ্টা কমিটি আছে, তারাই নিজেদের মধ্যে আলাপ করে বিষয়টি এগিয়ে নেবে।’
নতুন গেজেট প্রকাশ এবং আলাদা বিভাগ হিসেবে এনবিআরের কার্যক্রম শুরুর সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেওয়া যায়। বাজেটের পরই বিষয়টি এগোবে।’
এ বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘অর্থ উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনেছেন। এখন বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কিছু কাজ করবে।’
বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’–সংক্রান্ত পরামর্শ উপস্থাপন করেন বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের প্রতিনিধিরা। অধ্যাদেশ নিয়ে তাদের উদ্বেগ, মতামত ও সুপারিশ গুরুত্বসহকারে শোনা হয়েছে এবং উপদেষ্টা তাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, উত্থাপিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
অর্থবছরে বাজেট ভারসাম্যে নতুন চাপ
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ববর্তী বছরগুলোর ঘাটতির ধাক্কা সরকার সামাল দিয়েছে মূলত বিদেশি ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে ধার নিয়ে। তবে বারবার ঋণ নেওয়ার কারণে সুদ পরিশোধে সরকারের বার্ষিক ব্যয় বাড়ছে, যা পরবর্তী অর্থবছরে বাজেট ভারসাম্যে নতুন চাপ তৈরি করবে।
সরকার সম্প্রতি এনবিআর পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ নামে দুটি পৃথক সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটি কার্যকর হলে এনবিআরের একাংশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং কলম বিরতিতে যায়। এতে করে কাস্টমস ছাড়পত্র, ভ্যাট রিটার্ন যাচাই ও আয়কর রিটার্ন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘এনবিআর কর্মকর্তাদের এই কর্মবিরতি রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই অবস্থানে যাবেন- এটা কাম্য নয়।’ এই ক্ষতি কি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, এই ক্ষতি পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর আগের মাসে এই অঙ্ক ছিল ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক মাসে বেড়েছে ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ৫৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা প্রায় ২৫ শতাংশ ঘাটতির সমান।
সরকার শুরুতে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামানো হলেও আদায়ের বাস্তবতা তা থেকেও অনেক দূরে রয়ে গেছে। বর্তমান গতি অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠবে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক- তিনটি বড় খাতেই রাজস্ব ঘাটতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে আয়কর খাতে, যার পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। আমদানি হ্রাস পাওয়ায় অগ্রিম কর আদায় কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন ও সরবরাহ সংকটে ভ্যাট আদায় ব্যাহত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ব্যাংকে আমানত হ্রাস পেয়ে আবগারি শুল্ক থেকেও রাজস্ব প্রত্যাশিত মাত্রায় আসেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘কর্মবিরতির কারণে রাজস্ব আদায় ব্যাহত হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দ্রুত সমাধান হলে তা অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’
তবে সরকারি পরিকল্পনায় যে ধরনের আকস্মিক রদবদল আনা হয়েছে, তা নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, সেটি সহজে দূর হবে না বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক বিশ্লেষকরা।
আন্দোলনে রাজস্ব ঘাটতি ১১ হাজার কোটি টাকা
তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অথচ আন্দোলনের প্রস্তুতি ও জেরে মে মাসের প্রথম ১৮ দিনে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই গতিতে রাজস্ব আদায় হলে মে মাসে রাজস্ব আদায় হতে পারে ১৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। যেখানে গত বছরের মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিসহ আদায় হলে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা। আর ১৮ দিনে প্রবৃদ্ধিসহ আদায় হলে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হতো। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) পূর্বাভাস দিয়েছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
পদোন্নতি আটকে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই আন্দোলন
অধ্যাদেশ জারির পর থেকে গেল পাঁচ দিন কলম বিরতি পালন করেছে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে এনবিআর ভাগ করা নিয়ে তাদের তেমন আপত্তি নেই। এনবিআর ভেঙে নতুন যে দুটি বিভাগ করা হচ্ছে, সেখানে পদ-পদবি নিয়ে তাদের মূল আপত্তি বলে মত অনেকের।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতা ও অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ড বলেন, ‘রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব আসতে হবে রাজস্ব খাত থেকে। রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ লোকেরাই এ খাতের ভালো-খারাপ দিকগুলো বুঝতে পারেন। শুল্ক-কর নীতি প্রণয়ন ও আদায় অন্য লোকেরা করলে বাস্তবসম্মত না-ও হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে সংস্থাটির সদস্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। বিকল্প হিসেবে সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারবে। কিন্তু গত ৫০ বছরে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো সদস্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে শীর্ষ কর্মকর্তা বাইরে থেকে আসায় এনবিআর ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুনভাবে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের পরিকল্পনা হয়েছে, যেটি অর্থ বিভাগ ও ইআরডির মতো কাজ করবে। তবে এতে এনবিআর ও মাঠপর্যায়ের শুল্ক-কর প্রশাসনের পদ-পদবি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে এনবিআরে কর্মকর্তা পর্যায়ে সদস্য, প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিব- এই তিন পদ রয়েছে। আর মাঠপর্যায়ে কাজ করেন সহকারী কমিশনার, উপকমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও কমিশনার।
কিন্তু নতুন রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ হবে সরকারের সাধারণ প্রশাসনের মতো। সেখানে সাধারণত সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব- এই ধরনের পদ থাকে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের এই নতুন বিভাগে কীভাবে পদায়ন করা হবে। কারণ তাদের পদমর্যাদা ও কাজের ধরন এক নয়, অথচ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ নিয়ে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।