প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ২২:১৮ পিএম
শ্রীলঙ্কা থেকে চকলেট (কিন্ডারজয়) আমদানিতে কোটি টাকার বেশি শুল্ক-কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। শুধু রাজস্ব ফাঁকি নয়, শুল্ক-কর আদায় না করে পণ্য খালাস হয়ে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বরাবর এরূপ একটি অভিযোগ জমা পড়েছে, যা খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দিয়েছে এনবিআরের বোর্ড প্রশাসন।
অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয় ‘কিন্ডারজয়’ ব্র্যান্ডের একটি চালান। আইজিএম অনুযায়ী, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘বি অ্যান্ড বি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ চকলেট আমদানি করে ‘বিএস কার্গো’ নামক শিপিং কোম্পানির মাধ্যমে। চালানটি পাঠানো হয় ৩ জুলাই, কিন্তু তা খালাস করা হয় প্রায় সাড়ে চার মাস পর, ১৮ ডিসেম্বর।
দুটি ইনভয়েসে এই চালানের মোট মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৯২ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা (এক ডলার ১২০ টাকা ধরে)। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দাখিল করা বিল অব এন্ট্রিতে দেখানো হয় মাত্র ৪৬ হাজার ৮৪১ ডলার। বাকি প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্যমূল্য গোপন রাখা হয়। এতে করে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়।
অভিযোগ বলছে, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই অনিয়ম ঘটিয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিপ্লব ট্রেড ওভারসিজের সহায়তায়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আলতাফ হোসাইন চৌধুরী বাচ্চু, যিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, পণ্যটি ভারত থেকে উৎপাদিত হলেও তা শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। ইনভয়েসে আমদানিকারক দাবি করে, তারা পণ্যটি কিনেছে দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসি নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে। অথচ মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে শ্রীলঙ্কার দি কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব সিলনের মাধ্যমে। বিষয়টি প্রথম থেকেই সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয় ১০ নভেম্বর, যার নম্বর ২০৮০০৭২। অভিযোগে আরও বলা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে থাকা সিন্ডিকেটের সহায়তায় চালানটি ‘আন্ডারভ্যালু’ করে খালাস করা হয় এবং এর বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া হয় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের বোর্ড প্রশাসন শাখার প্রথম সচিব মো. জাহিদ নেওয়াজ বলেন, ‘যেকোনো অভিযোগ পেলে আমরা তা সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে থাকি। সত্যতা মিললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অন্যদিকে সিঅ্যান্ডএফ নেতা আলতাফ হোসাইন চৌধুরী বাচ্চুর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বর্তমান কমিশনার জাকির হোসেনও কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
তৎকালীন কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘কিন্ডারজয় পণ্যে চকলেট ও খেলনা একত্রে থাকে। শুল্কায়নের ক্ষেত্রে আলাদা বিবেচনা করতে গিয়ে চালানটি লক করেছিলাম। পরে এনবিআরের নির্দেশে তা খালাস করা হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।’
তবে রাজস্ব প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, অতীতে বাচ্চুর লাইসেন্স ব্যবহার করে এমন আরও কয়েকটি চালান খালাস করা হয়েছে, যেগুলোতে অনুরূপ ভুয়া ঘোষণা ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগকারীদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময় বাচ্চু কাস্টম হাউসে প্রভাব খাটিয়ে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। সিন্ডিকেটটি এনবিআরের একাংশকে ব্যবহার করে একের পর এক চালান খালাসে শুল্ক ফাঁকির কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
বলা হচ্ছে, যদি কাস্টমস চালানটির মূল ইনভয়েস ও অন্যান্য নথিপত্র যাচাই করে জরিমানা আরোপ করত, তবে এই একটি চালান থেকেই সরকার প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করতে পারত। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এই অর্থ হারিয়েছে রাষ্ট্র।