আহমেদ ফেরদাউস খান
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০৭ এএম
বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার দিনেই বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি তিন মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই তিন মাস ১০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে সেসব দেশকে। তবে কানাডা, মেক্সিকো ও চীনকে এই তালিকার বাইরে রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বরং চীনের জন্য শুল্কহার ১০৪ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল হঠাৎ করে অর্ধশতাধিক দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্কারোপ করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে আগে থেকেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর জারি থাকা ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে নতুন ৩৭ শতাংশ যুক্ত হয়ে শুল্ক দাঁড়ায় ৫২ শতাংশে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তিন মাস খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে কীভাবে শুল্ক কমানো যায় এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বাড়ানো যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন কৌশল নিয়ে সামনে এগোতে হবে।
তারা বলছেন, এই তিন মাসকে সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, কিন্তু সময় অনেক কম। সরকারকে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। কীভাবে এই শুল্ক কমানো যায়, তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় অর্থনীতির দেশ। যতটা সম্ভব সমঝোতার মাধ্যমে শুল্ক কমিয়ে আনা যায়, সেটাই লাভ। কৌশল আর আলোচনা করে এগিয়ে যেতে হবে সরকারকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এই বিরতি বাংলাদেশকে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। চীন শুল্কের মুখে পড়ায় আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের এক শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আগামী ৯০ দিনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কতটা কার্যকরভাবে দরকষাকষি করতে পারছে এর ওপর।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) তাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে শুল্কারোপ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি লিখেন, আমরা আপনার বাণিজ্যনীতির সমর্থনে আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।
বেশ কয়েকজন পোশাক কারখানার মালিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, আগামী ৯০ দিনের বিরতিতে তারা স্বস্তি অনুভব করছেন। তবে উদ্বেগ রয়েই গেছে। বাংলাদেশের তৈরি বেশিরভাগ পোশাকে ২০ শতাংশেরও কম মার্কিন তুলা ব্যবহার করা হয়।
ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক ৯০ দিন পর কার্যকর হলে বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্প সংকটে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারকদের ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক গুনতে হবে। সেই ঘোষণায় ২০ শতাংশের কম মার্কিন তুলার টি-শার্টে শুল্ক ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। সর্বশেষ ৩৭ শতাংশ শুল্ক আগের শুল্কের সঙ্গে যোগ হওয়ায় তা ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন কয়েকটি শীর্ষ পোশাক কারখানার মালিক।
যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা ১০৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বাজারের ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বহাল থাকায় চীন ইউরোপের বাজারে সস্তা কাপড়ের বন্যা বইয়ে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য আরেকটি সমস্যা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেন, সরকারের উচিত মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা শুরু করা। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় এক বিদেশি ক্রেতা আগের কার্যাদেশ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপে ৯০ দিনের বিরতি চেয়ে গত সোমবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে চিঠি দেন ড. ইউনূস। অন্যদিকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ পণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা চেয়ে বাণিজ্য প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারকে আলাদা চিঠি দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, তিন মাস সময় পেয়েছে সরকার। শুল্ক কমানো ও আমদানি বাড়াতে কাজ করছে সরকার। ট্যারিফ কমিশন দেখছে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক কমানো যায় এবং দেশের কাঁচামাল আমেরিকা থেকে আমদানি বাড়ানো যায়, সেটাও দেখছে সরকার। আশা করি এই তিন মাস সময়ের মধ্যেই সরকার একটা সমাধান করবে এবং এর সমাধান খুব দ্রুত সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, তিন মাস খুবই শট টাইম। আর এই শুল্কারোপ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পলিসি। চীন ছাড়া সব দেশেই এই শুল্ক স্থগিত করেছে। হুট করে শুল্কারোপ করেছে, হয়তো দেশগুলোতে একটু সময় দিয়েছে, যাতে ধাক্কাটা সামলে নেওয়া যায় এবং দেশগুলো যাতে রি-মডেলিং করতে পারে এজন্য। শুল্কারোপের ফলে ওই দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বাড়বে। আর দাম বাড়লে চাহিদা কমবে। এখন বাংলাদেশ একটা সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগে বাংলাদেশের উচিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টা নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যদি ফ্যাকচারাল চেঞ্জ না হয়। তাহলে এই তিন মাসে বেশি কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। একটা প্রাথমিক ধাক্কা ছিল, সেটা সামলানো গেছে। শুল্কারোপ স্থগিত করায় আপাতত স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ। পলিসিটা যদি বাংলাদেশ থেকে হতো, তাহলে এক রকম হতো। পলিসি তো এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হচ্ছে। ওরা ডিসাইড করছে। শুল্ক কত হবে বা হবে কি না। বাংলাদেশ চাইলেই পাল্টা পলিসি নিতে পারবে না। সমঝোতা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
গবেষণা ও নীতি সহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তিন মাস সময় দিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। আলোচনা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। এখন আমাদের উচিত এই ইস্যুটা নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা এবং একটি সমাধানে আসা।’