প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৫৩ পিএম
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বৃহস্পতিবার চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলনের সমাপনী প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি। সংগৃহীত
বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি যেন কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, তা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ ও মনিটরিং করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি। তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) বিকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলনের সমাপনী প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ মাহবুব, প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারী যারা বাংলাদেশে এসেছেন তারা যেন সত্যিকারের বিনিয়োগ করে, সেজন্য তাদের আমরা ধারাবাহিকভাবে মনিটরিং করব। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় নেয় বিনিয়োগ করতে, তাদের সঙ্গে আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধরে যোগাযোগ করব। আমাদের এখানে সাড়ে ৫০০ রেজিস্ট্রেশন ছিল, এর মধ্যে প্রায় ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ বিদেশি প্রতিনিধি এসেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুজন প্রতিনিধি এসেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন। নীতির ধারাবাহিকতা, একসেস টু রিসোর্স ও দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অতীতে বৃহৎ মন্ত্রিপরিষদ থাকার কারণে বিনিয়োগাকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হতো। এখন উপদেষ্টাদের সংখ্যা কম, যার কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসা সহজ হয়েছে। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে কাগজপত্র ছাড় করতে ব্যবসায়ীদের সময়ক্ষেপণ করতে হয়। এই জটিলতা থেকে উত্তরণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এগুলো দেখেছেন এবং আশ্বস্ত হয়েছেন।’
গত সামিটগুলোতে সভা-সেমিনারে নজর ছিল বেশি, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এবারের সামিটে জিটুজি ও বিটুবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সামিট উপলক্ষ্যে চীনা আরএমজি প্রতিষ্ঠান হান্ডার সঙ্গে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এছাড়া শপআপ ১১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। এখনো সামিটের দুটি সেমিনার বাকি আছে যার কারণে বিনিয়োগের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এই মূহুর্তে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে সামিটের অর্জনের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।’
ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের সস্তা শ্রম থাকলেও বেশি মুনাফা করা যায় না। এমন ইস্যু সম্মেলনে এসেছে। সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের কী জবাব দিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিয়ান বলেন, ‘ভিয়েতনামের উচ্চ মূল্যের সিন্থেটিক ফেব্রিকের পোশাক উৎপাদন করা হয়, এ কারণে মুনাফাও বেশি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সিন্থেটিকের উচ্চমূল্যের তৈরি পোশাক উৎপাদন হয় না এ কারণে মুনাফা কম। দুয়েকজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ শুরু করেছেন, বাংলাদেশেও হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের পরিবর্তন হলেও বিনিয়োগকারীদের কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আগের অবস্থায় বহাল থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে- এমন সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।’
পোশাক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে
গতকাল সকালে ‘টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল’ শীর্ষক সেশন পরিচালিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা কিহাক সুং। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ একক দেশ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে; শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নত করতে হবে।’
কিহাক সুং নীতিগত সহায়তার গুরুত্ব এবং আরও বেশি বন্ডেড গুদাম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘এগুলো কাঁচামাল সহজে প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করবে, যার ফলে প্রস্তুতকারকরা আরও দক্ষতার সঙ্গে পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি করতে পারবে।’
ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়বে।’
নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিতে ডিজিটাল অর্থনীতি শীর্ষক পৃথক আরেক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ জানান, সরকার চলতি মাসের শেষ নাগাদ ‘সাইবার সেফটি অধ্যাদেশ’ গেজেট আকারে প্রকাশ করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সাইবার সেফটি অধ্যাদেশ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কাজ করছি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা সকল উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছি। তাই আশা করছি, চলতি মাসের শেষ নাগাদ আমরা একটি নতুন সাইবার সেফটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে পারবো।’
ফয়েজ আহমদ ব্যবসায়িক পরিবেশে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসাগুলোকে সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে।’
সিটি ব্যাংক এন.এর কান্ট্রি অফিসার মো. মইনুল হক বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময় ডিজিটাল অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সে সময়ে এটি ব্যবসা চালু রেখেছে, দূর থেকে কাজের সুযোগ দিয়েছে, ই-কমার্সকে শক্তিশালী করেছে এবং মানুষকে যুক্ত রেখেছে যখন প্রচলিত কাঠামোগুলো ব্যাহত হয়েছিল। এটি শুধু বিকল্প নয়, বরং মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রান্তে একটি যুগ যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, এআর ও ভিআর, ৩ডি প্রিন্টিং, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন, বায়োটেকনোলজি, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি, ইন্টারনেট অফ থিংস এবং রোবোটিক্সের দ্বারা সংজ্ঞায়িত।’
এই প্রযুক্তিগুলো শিল্প পরিবর্তন, প্রচলিত মডেলগুলোকে চ্যালেঞ্জ এবং কাজ ও জীবনের ধরণকে পুনর্নির্ধারণ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লব একদিকে বিশাল সম্ভাবনা এবং অন্যদিকে বড় দায়িত্ব একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভবিষ্যতমুখী, স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলার সুযোগ।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল রূপান্তরের জাতীয় কৌশলপত্রের খসড়া অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রধান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হাবে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে।’
এছাড়াও, তিনি বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে শীর্ষ ১৫ দেশের মধ্যে স্থান পেতে, ৭ থেকে ৮ মিলিয়ন দক্ষ আইসিটি পেশাজীবী তৈরি, স্টার্টআপে বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে এবং আইসিটি রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়।’